দিল্লি শব্দটা মদন আর নবর মাঝখানে লাট্টুর মতো ঘুরছে।
নবর একটা হাত জামার তলায়। কোথায় তা মদন আন্দাজে ধরে। কিন্তু ভাল করে তাকায় না।
দু’জনের মাঝখানে ঘুরতে ঘুরতে ‘দিল্লি’ শব্দটার দম ফুরিয়ে গেল। কোমর নেতিয়ে সেটা ঢলে পড়ছে। নব শব্দটাকে ক্যাচ করবে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
বিরক্ত মুখে মদন তার গমগমে গলা আর একটু তুলে হাঁক দিল, পুনম, কফি।
তারপর যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে নবর দিকে তাকায় সে। তুই কি বিশ্বাস করিস না আমি কল্পতরু? আমি কামধেনু? সারা ভারতবর্ষে ক’টা এমপি আছে খুঁজে দেখে আয়। সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন আমি। আমি ঘুরিয়ে দিতে পারি তোর ভাগ্যের চাকা। মরা মানুষ জ্যান্ত করি রোজ। জ্যান্ত মানুষ মারি। আমি বললে নদী উজানে বয়, রাতের বেলা রোদ ওঠে। ক্যাচ কর নব, দিল্লি শব্দটা ক্যাচ কর। দিল্লিতে কুতুবমিনার আছে, দেখবি চল। দিল্লিতে আছে লালকেল্লা। আছে পার্লামেন্ট। আছে ইচ্ছাপূরণ। ক্যাচ কর নব।
ঘুরতে ঘুরতে দিল্লির লাট্টু যখন মাটি ছুঁই ছুঁই তখন নব হঠাৎ ক্যাচ করল।
দিল্লিতে গিয়ে কী হবে? খুব ঠান্ডা হিসেবি গলায় সে প্রশ্ন করে।
আর একটা সিগারেট ধরানোর সময় মদন ভাল করে লক্ষ করে, তার হাত কাঁপছে কি না। না, কাপছে না, এখনও সব ঠিক আছে। কেউ উঠে গিয়ে স্টিরিওটা বন্ধ করছে না। মদন, তোয়ালে পরা মদনই, উঠে গিয়ে রেকর্ডটা পালটে দিয়ে এল। ভরাট একটা গলা গাইছে, সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা… বহোৎ আচ্ছা বহোৎ আচ্ছা’ বলে মনে মনে হাসল মদন।
সিগারেটে দীর্ঘ একটা টান দিয়ে চিত হয়ে ওপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে মদন বলে, কী আর হবে। এখানে থাকলেও কিছু হবে না। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসে মদন নবর দিকে তাকায়, আমি কখনও সঙ্গে আর্মস নিয়ে চলেছি, দেখেছিস? (সেই স্মৃতিটুকু কভু খণে খণে যেন জাগে মনে ভুলো না…)
জামার তলায় নবর হাত একটু কঠিন হয়। এর ছায়ায় তার চোখের মণি মারবেলের মতো স্থির।
মদন গলাটা বেস-এ নামিয়ে আনে। খুব আস্তের ওপর গলাটা রোল করিয়ে বলে, আমার আর্মস লাগে না। লাগে নাকি রে নব? (সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো–আমারি মনের প্রলাপ জড়াননা, আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা..)
নব চুপ। কিন্তু এখনও কথাটা তোলা, দুলছে।
আর্মসের চেয়েও বেশি কিছু থাকলে আর্মসের দরকার পড়ে না। নিত্য ঘোষের ক’জন বডিগার্ড তা জানিস?
ফালতু বাত ছাড়ো মদনদা। আমি জানতে চাই, নীলুকে কে মেরেছিল, আর কেন তোমরা আমাকে নীলুর কেসে ফাসিয়েছিলে!… (ভুলো না, ভুলো না, ভুলো না…)।
একটু ফ্যাকাসে মেরে গেল কি মুখটা? নিজের মুখ তো মানুষ এমনিতে দেখতে পায় না। মদন তাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। (এখন আমার বেলা নাহি আর.) গলাটাকে আর একটা পর্দায় বেঁধে উদাস আনমনা স্বরে বলে, দিল্লি থেকে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল, এলিমিনেট নিত্য ঘোষ।
বলে একটু ফাঁক দিয়ে মদন গলার স্বরটা একদম খাদে ফেলে দিয়ে বলে, দি জব ইজ ডান। যে সব ভূতপ্রেত আজ নিত্য ঘোষের হয়ে তাণ্ডব নৃত্য করছে কাল থেকে তারা ওর গলায় দাত বসাতে শুরু করবে। দি জব ইজ পারফেকটলি ডান।
জামার তলায় নবর হাত একটু কি শ্লথ? কিন্তু সেদিকে সরাসরি তাকায় না মদন। পিছন দিকে হেলে আধবোজা স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে সে নিজের সিগারেটটাকে দেখে। স্বপ্নাচ্ছন্ন গলাতেই বলে, তোর প্রােটেকশন নেই। কিন্তু সেটা তুই এখনও জানিস না।
কিন্তু ওসব কথায় কান দেয় না নব। ঠান্ডা গলাতে জিজ্ঞেস করে, দোস্তকে কি দোস্ত খুন করে মদনদা? বললা তুমি! আমি কি আমার দোস্তকে মেরেছি?
শুনতে হয় না, সব কথা শুনতে হয় না। মদনও এক পরিচ্ছন্ন অন্যমনস্কতায় কথাটাকে পাশ কাটিয়ে উদাস গলায় বলে, শ্ৰীমন্তও ঠিক এই ভুলটা করল। ভাবল মদনের দিন শেষ, এবার নিত্য ঘোষ আসছে। তোকেও কেউ কি তাই বুঝিয়েছে নাকি রে নব?
তুমি আমার কথাটার জবাব দিচ্ছ না মদনদা?
মদন স্টিরিয়োর স্বরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, বাঁধিনু যে রাখি পরানে তোমার সে রাখি খুলল না…
পুনম কফির ট্রে নিঃশব্দে রেখে চলে যায়। মদন কফির ওপর ঝুঁকে পড়ে। এ সময়ে ড্রিংকসের মাঝখানে হঠাৎ কফির এই আকস্মিক আগমন ঘটার কথা নয়। তবু ঘটিয়েছে মদন। ডাইভারসন, একটু ডাইভারসন দরকার। একটু ফাঁক, একটু শ্বাস ফেলার অবসর, একটু ঝটিতি চিন্তার অবকাশ।
কফি?–বলে মদন নবর দিকে ভ্রূ তুলে তাকায়।
কফি শব্দটা আবার লার মতো ঘুরতে থাকে দু’জনের মাঝখানে, ক্যাচ করবে কি নব? (এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার…)
জামার তলা থেকে হাতটা বের করে আনে নব। হাতটা ফাঁকা। সেই হাতটাই কফির কাপের দিকে এগিয়ে আসে।
স্টিরিয়ো থেকে ঘষটানির শব্দ আসছে আবার। বিকৃত মুখ করে মদন ওঠে। আর একটা রেকর্ড চাপিয়ে দিয়ে আসে। আ-আ-আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…
হাসলে নবকে ভালই দেখায়। নব হাসল। স্বরটা নিচু করে বলল, নীলুর কথাটা তুমি তুলতে চাও না, না মদনদা?
ঠিন করে প্লেটের ওপর চামচ রাখে মদন। আঃ’ বলে একটা আরামের শ্বাস ছাড়ে। গুন গুন করে গায়কের সঙ্গে গায়, চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি… গাইতে গাইতে আড়চোখে নবকে এক পলক দেখে নেয়। দিল্লিতে কুতুবমিনার আছে। লালকেল্লা আছে। আছে প্রোটেকশন। কলকাতার পুলিশ নেই সেখানে। বাচ্চেলোক, দেখো দিল্লি, দিল্লি দেখো। ড়ুগ ড়ুগ ড়ুগ ড়ুগ…