দুঃখের গলায় মাধব বলে, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় নীলুকে বোধহয় তুই মারিসনি।
কথাটা গ্রাহ্য না করে নব ঠান্ডা গলায় বলে, আমি নীলু তোমাদের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। সন্ধেবেলা। বকুলতলার মোড় পার হওয়ার সময় বোম চার্জ হয়। কী হয়েছিল আমি জানি না, আমি ফেইন্ট হয়ে পড়ে যাই। এক ঘণ্টা আমার জ্ঞান ছিল না।
এখনও হাঁ করে আছে মাধব। হাতের পিঠে খুঁতনি ঘষতে গিয়ে টের পেল। সোফায় মুখোমুখি নব। বেঁটেখাটো মজবুত চেহারা, জেলের ভাতেও চেহারা ভেঙে যায়নি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ওর ঠান্ডা চোখ। তাকালেই গুড় গুড় করে বুক কাপে। মাধব বলল, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। নব, এখন কী করতে চাস তুই? নীলুর জন্য আমাদের আর কী করার আছে বল!
যারা টিকিট কেটেছে তাদের নিয়ে মাথা ঘামাই না। টিকিট না কাটলে নীলু ভি লিডার হত। আর শালা কে না জানে, লিডার হলে নীলু আর নীলু থাকত না। যেমন মদনদা নেই। যেমন কেউ নেই। অনেকক্ষণ ধরে তোমার শাওয়ারের জল পড়ে যাচ্ছে মাধবদা। বাথরুমে কে বলো তো?
.
বাথরুমে জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে মদনেরও মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হারিয়ে গেছে। চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন সে খালি হাতে যে কোনও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারত। তার দিকে চেয়ে কেউ তাকে অমান্য করার সাহস পেত না কখনও।
আর একবার বমি করল মদন। হুইস্কির শেষ তলানিটুকুও তুলে দিল পেট থেকে। ঠান্ডা জলে এখন একটু শীত শীত করছে তার। তবু সে শাওয়ার বন্ধ করল না। মাথায় ড়ুগড়ুগি বাজিয়ে জল পড়ছে। জাগ্রত হচ্ছে বিবেক, আত্মসচেতনতা, প্রশ্ন, বিশ্লেষণ, একটু উল্টোপাল্টা হয়ে অবশ্য।
কিন্তু কী যে হারিয়ে গেছে তা খুব স্পষ্ট বোঝা গেল না। তবে হারিয়েছে ঠিকই। নইলে এতক্ষণে সে দরজা খুলে নবর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারত।
বাথরুমের দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। কে যেন চাপা গলায় ডাকছে, মদনদা! মদনদা!
মদন শাওয়ার বন্ধ করে দেয়, কে?
আমি জয়।
ও। কী চাও?
একবার বাইরে আসুন।
মদন মুখটা বিকৃত করে। তারপর বলে, আসছি।
স্নানের পর অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে মাথা। মদন বিশাল ভোয়ালেটা টেনে নিয়ে মাথা আর গা মোছে। জামাকাপড় ভেজা, বাথরুমে বিকল্প কিছু পরারও নেই। মদন আবার মুখ বিকৃত করে।
তোয়ালে দিয়ে আয়নাটা মুছে সে নিজের মুখটা ভাল করে দেখে নেয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নব পলিটিক্যাল প্রােটেকশন পেয়ে গেছে। না হলে জেল-পালানো কয়েদি প্রকাশ্য রাস্তায় ঘুরে বেড়াত না, বা এত সহজে নাগাল পেত না মদনের। কারা নবকে প্রােটেকশন দিয়েছে তা আন্দাজ করাও শক্ত নয়। তবে স্বচ্ছ মাথায় মদন বুঝতে পারছে, নবর নিশ্চয়ই আরও কিছু চাওয়ার আছে। চাওয়াই তো মানুষের সবচেয়ে সহজ রন্ধ্র।
মদন তোয়ালে জড়িয়ে নেয় কোমরে। একটু ফ্যাট হচ্ছে পেটে, এই সংকটের সময়েও লক্ষ করল সে। কমাতে হবে।
বাথরুমের দরজা খুলে মদন বাইরে পা দেয়। কাজটা হয়তো ঠিক হল না। কিন্তু উপায়ও তো নেই।
ডাইনিং হলের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। বসবার ঘরে সোফায় বসে বিবর্ণ হাঁফাচ্ছে মাধব। ছাইয়ের মতো সাদা মুখ নিয়ে জয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। সিংগল সোফায় নব! বুকটা একটু কেঁপে উঠল মদনের। কিন্তু মুখে তার ছায়া পড়ল না। পার্লামেন্ট অ্যাড্রেস করা গম্ভীর গমগমে গলায় হাঁক দিল, পুনম! কফি।
ডাইনিং হলের দেয়ালের একটা খাঁজে স্টিরিও সহ রেকর্ড প্লেয়ার। রেকর্ড একটা চাপানোও আছে। মদন শিস দিতে দিতে গিয়ে সেইটে চালু করল। কী গান বাজবে তা জানে না সে। ঘষটানো একটু আওয়াজের পর হঠাৎ দেবব্রতর গলা তাকে জিজ্ঞেস করল, পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…। মদন রসিক আছে। দু’হাতের ঝাপটায় লম্বা চুল থেকে জল ঝরাতে ঝরাতে সে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকেই। কিন্তু থমকায় না। অনেকদিন বাদে নবর সঙ্গে এই মুখোমুখি।
আঃ!–বলে একটা আরামের আওয়াজ করে সোফায় বসে মদন। একটা সিগারেট ধরিয়ে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে নবর দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, খবর পেয়েছি।
নব কথা বলল না। ক্রুর কুটিল এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। (মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়…)
মদন সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, পার্টির সব খবর পেয়েছিস তো?
কীসের খবর? (হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়…)
নিত্য ঘোষ আলাদা দল করছে এখানে। তোকে প্রােটেকশন দিয়েছে, তাও জানি।
তুমি আমাকে ফাঁসিয়েছিলে, আর নিত্য ঘোষ আমাকে প্রােটেকশন দিচ্ছে। তোমার আর আমার সম্পর্কটা এখন একটু অন্যরকম মদনদা।
মদন হাত তুলে একটা বিরক্তির ভঙ্গি করে নবকে চুপ করিয়ে দেয়। তারপর স্থির প্রশান্ত দৃষ্টিতে নবর চোখে চোখ রেখে বলে, কাজ করতে চাস? (আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়…)
নব চেয়েই থাকে।
মৃদু হেসে মদন বলে, তোর বউকে চাকরি দিয়ে আজই দিল্লি পাঠিয়ে দিয়েছি। নইলে খামোকা পুলিশ গিয়ে মেয়েটার ওপর হুজ্জতি করত। তুইও যাবি?
কোথায়?
দিল্লি?
রেকর্ড শেষ হয়ে স্টিরিওতে একটা ঘষটানির শব্দ বাজছে। বেজেই যাচ্ছে। আড়চোখে মদন লক্ষ করল। কার কাছে আর্মস আছে বা নেই তা সে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে টের পায়। নবর কাছে আছে। থাকারই কথা।