ঝুপসি ছায়ার নীচে, বহু দুরের অস্পষ্ট ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝিনুকের অবাক দুখানা চোখের দিকে মাত্র একপলক চেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। তারপরই কাণ্ডজ্ঞানহীন তার ঠোঁট নেমে যেতে থাকে ঝিনুকের ঠোঁটের দিকে।
কিন্তু কোটি কোটি মাইলের সেই দূরত্ব কী করে পেরোবে বৈশম্পায়ন? ঝিনুক বাধা দেয়নি, চেঁচায়নি, শুধু চেয়ে ছিল। কিন্তু সেই অবাক চোখের ভিতর থেকে অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ গর্জন করে ওঠে মহাসমুদ্র। বৈশম্পায়ন দেখে, করাল বিশাল আদিগন্ত এক সমুদ্রের পাকানো ঢেউ গড়িয়ে আসছে চরাচর গ্রাস করতে। বিপুল গর্জনে ফিরে যাচ্ছে আবার। ঢেউ উঠে যাচ্ছে আকাশে, নেমে যাচ্ছে। পাতালে।
কোটি কোটি মাইলের দূরত্ব। কোটি কোটি মাইলের দূরত্ব। সে সেই দূরত্ব অতিক্রম করার চেষ্টা আর করে না।
ফিস ফিস করে বৈশম্পায়ন বলল, ইট উইল নট বি এ ওয়াইজ থিং টু ড়ু মাইডিয়ার।
ঝিনুক খুব আস্তে, প্রায় বিনা আয়াসে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। বলল, চলুন। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।
আবার দু’পা এগিয়ে ঝিনুক। দু’পা পিছনে বৈশম্পায়ন। আলোছায়াময় এক অপরূপ নির্জনতা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। দুজনেই চুপচাপ। বৈশম্পায়ন কোনওদিনই আর সেই ফটো তোলার কথা বলতে পারবেনা ঝিনুককে। ঝিনুক কোনওদিনই আর পারবে না বৈশম্পায়নকে মনে করিয়ে দিতে।
.
ঠিক সময়ে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে পেরেছিল মদন। এক পাটা কাঠের মজবুত দরজা, পেতলের হুড়কো। সহজে ভাঙবে না।
অসহ্য গরমে ভেপে আছে বাথরুম। অসহ্য গরমে ভেপে ঘেমে গলে যাচ্ছে মদন। নেশা হয়নি, কিন্তু তা বলে হুইস্কি তার কাজ করতেও ছাড়ে না তো।
বেসিনে উপুড় হয়ে গলায় আঙুল দিল মদন। হড় হড় করে টাটকা হুইস্কির স্রোত নেমে গেল নল বেয়ে। মদন শাওয়ারের চাবিটা ঘুরিয়ে দিয়ে তলায় দাঁড়ায়। বুলেটের মতো এক ঝাক ঠান্ডা জল নেমে আসে। সম্পূর্ণ পোশাক পরা অবস্থায় মদন দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তীব্র তীক্ষ্ণ জলকণার নির্দয় আক্রমণ সে সমস্ত শরীর দিয়ে শুষে নিতে থাকে।
দেয়ালে মস্ত একটা চওড়া আয়না মুখোমুখি। সেটার গায়ে অজস্র জলের ছিটে গিয়ে লেগে আছে। তবু অস্পষ্ট নিজের প্রতিবিম্ব তাতে দেখতে পাচ্ছে মদন। খুবই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। লোকসভার এক মাননীয় সদস্য শাওয়ারের তলায় জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তার মুখটা হা হয়ে আছে। কয়েকবারই চেষ্টা করে দেখল মদন, হাঁ মুখটা স্থায়িভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। যতবার বন্ধ করে ততবার দুর্বল চোয়ালের খিল আলগা হয়ে মুখ হা হয়ে যায়।
বসবার ঘরে চোয়াল নিয়ে একই সমস্যা দেখা দিয়েছে মাধবেরও। তবে সে যে হাঁ করে আছে তা সে বুঝতে পারছিল না। তাই সে হ মুখ বন্ধ করার কোনও চেষ্টাও করেনি।
দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিশ্বাসঘাতক জয় দাঁড়িয়ে। সন্দেহ নেই, ওরা বিশ্বাসঘাতকের বংশ। এক ভাই তার বউকে নিয়ে পালিয়ে গেছে, আর এক ভাই ডেকে এনেছে তার নিয়তিকে।
নব পাপপাশে তার চপ্পলজোড়া মুছে আসেনি। ধুলোটে চপ্পলের ছাপ পড়ল কার্পেটে। নব সোফার হাতলে একটা চপ্পলসুদ্ধ পা তুলে দিয়ে বলল, মাল খাচ্ছ?
বলে নব হাত বাড়িয়ে একটা খালি বোতল তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, বাঃ! ফরেন জিনিস! বোতল কত করে নেয় বলো তো আজকাল।
মাধব হাতের পিঠ দিয়ে খুঁতনি ঘষতে গিয়ে টের পেল, তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। নবর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে সে একটু কমিয়ে বলল, আশি টাকা।
নব অবশ্য মদের দাম জানতে আসেনি। বোতলটা আবার জায়গামতো রেখে সে বলল, আমাকে দেখে ওরকম চেঁচালে কেন বললা তো মাধবদা! ভয় খেয়েছিলে? আমাকে তোমার ভয় কেন বলো তো? কোনওদিন তো তোমার সঙ্গে আমার কোনও খাড়াখাড়ি ছিল না।
তোর সঙ্গে আমার কোনও খাড়াখাড়ি নেই নব।
আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নব একটু হাসল, আগে ছিল না মাধবদা। কিন্তু এখন আছে।
তোর সঙ্গে খাড়াখাড়ি! আঁ! খুব হাসবার চেষ্টা করে মাধব। তোর সঙ্গে কীসের খাড়াখাড়ি রে? কী যে বলিস?
মদনদা কোথায় বলো তো। লুকিয়েছে?
মদন, ওঃ, তুই মদনকে খুঁজছিস? মদন চলে গেছে ক-খন।
মদনদার পাখা নেই মাধবদা। আর তোমার ফ্ল্যাট থেকে বেরোনোর দুসরা দরজাও নেই।
তা হলে কোথায়? বিশ্বাস না হয় খুঁজে দেখ।
খুঁজতে হবে না। বলে নব সোফা থেকে পা নামায় এবং মাধব সোফার হাতলে ওর চটির ছাপ দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঝিনুক থাকলে সোফায় দাগ দেখে এমন চেঁচাত।
নব সোফায় বসে বলল, আজ সারাদিন আরাম করে কোথাও বসিনি, জানো?
বোস, বোস, ভাল করে বোস। একটু হুইস্কি খাবি?
নব একটু হাসল, জেলখানায় আমাকে কী খাওয়াত জানো?
মাধব ঢোক গিলল।
নব ক্রুর চোখে চেয়ে বলল, মাজাকি রাখো।
তোর সঙ্গে মাজাকি কী রে? তুই আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু।
কে তোমার ভাইয়ের বন্ধু?
কেন, তুই। তুই নীলুর বন্ধু না?
তুমি সিধে কথার লোক নও মাধবদা। নীলু তোমার ভাই ছিল? না চাকর?
কী যে বলিস! সেই কবে ছেলেবেলায় ঘরের কাজ করত। কিন্তু আমরা ওকে কখনও চাকরের মতো ট্রিট করেছি, বল?
ফালতু বাত ছাড়ো মাধবদা। একটা সিধে কথা বলবে? আরও তো মেলা লোক ছিল, তবু নীলুর কেসে আমাকে সালে কেন?
আমি কেন ফাঁসাব? মার্ডারের সময় তুই ওর সঙ্গে ছিলি।
আলবাত ছিলাম। তাতে কী? নীলু আমার দোস্ত ছিল, লিডার ছিল।