ভূত। মেলা ভূত চারদিকে।
কার ভূত রে মাধব?
মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফার পিছন দিকে মাথা রেখে পড়ে থাকে। চোখ বোজা, আস্তে আস্তে কখন, কীভাবে তার চোখের কোল ভরে যায় জলে। ঠোঁট একটু কাপে। একটা দীর্ঘশ্বাস অনেকক্ষণ ধরে ছাড়ে সে।
মাধব।
উ।
এটা তো শোকসভা নয় রে। কিছু বল। নইলে জমছে না।
মাধব বিড়বিড় করে বলে, তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছে আকীর্ণ করি মানুষের লাশে…
দূর শালা মাতাল!
মদনা, একটা কথা বলবি? লিডার হতে গিয়ে তোকে মোট ক’টা খুন করাতে হয়েছে?
এবার সত্যি লাথি খাবি। যা বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপ করে ঘাড়ে মুখে ঠান্ডা জল দিয়ে আয়।
মাধব বেকুবের মতো অর্থহীন চোখে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, শোওয়ার ঘর থেকে নীলুর ছবিটা আমি সরিয়ে দিয়েছি।
মদন কিছু বলে না। কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ কুর চোখে চেয়ে থাকে।
মাধব রুমালে চোখ মুছে বলে, আফটার অল বাড়ির চাকরের ছবি শোওয়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না।
মদন গ্লাস তুলে ছোট চুমুক দেয়। চেয়ে থাকে স্থিরভাবে।
মাধব বলে, ঠিক করিনি? বল! আফটার অল হি ওয়াজ এ ডোমেস্টিক সারভেন্ট! বাসন মাজত, ঘর ঝাটাত, আমাদের পাত কুড়িয়ে খেত, আমাদের পুরনো জামাকাপড় পরে বড় হয়েছিল। ঠিক করিনি ছবিটা সরিয়ে দিয়ে? চুপ করে আছিস কেন?
শুনছি। বলে যা।
নীলু যত যাই হোক, ছিল আসলে চাকর। এইটুকু
মাধব হাত দিয়ে একটা মাপ দেখিয়ে বলে, এইটুকু থাকতে এসেছিল। শীতকালে কুঁকড়ে শুয়ে থাকত পাপোশে। একদম পোষা কুকুরের মতো। এঁটোকাটা খেত। হি ওয়াজ এ সারভেন্ট! সারভেন্ট!
চেঁচাচ্ছিস কেন?
চেঁচাচ্ছিস নাকি? ও বলে মাধব চোখ বোজ। আবার চোখের কোল ভরে ওঠে জলে। ঠোঁট নড়ে। তারপর বলে, চাকরের আস্পদ্দা! আঁ, চাকরের এত বড় আস্পন্দা।
গ্লাস নামিয়ে রেখে মদন তেতো মুখে বিরক্তির সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া হুস কবে ছাডে। কিছু বলে না।
মাধব চোখ বুজেই বলে, আম্পদ্দা নয়! তুই-ই বল! হি ওয়াজ ক্লাইমবিং আপ দি ট্রি অফ সাকসেস লাইক এ মাংকি! যেটায় হাত দেয় সেটাতেই ব্রিলিয়ান্ট। পাড়ার এঁদো স্কুল থেকে কেমন ফাস্ট ডিভিশন পেল। মাইরি, ভগবান কেন এত ছল্পড় ফুড়ে দিল ওকে বল তোর ভরাট গলায় যখন রবীন্দ্রসংগীত গাইত ঠিক মনে হত হেমন্ত। আর কী সাহস! কী ইন্টিগ্রিটি! মদনা, কথা বলছিস না কেন? আমি কিছু ভুল বলছি?
মদন গ্লাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে বলল, আর একটা কথা এখনও বলিসনি।
কী বল তো!
নীলু ছিল ঝিনুকের প্রেমিক। ভুলে গেছিস?
হাঃ হাঃ, তাই ভুলি রে পাগল?
তোর বউ বড্ড অন্যের প্রেমে পড়ে যায়।
হাঃ হাঃ। যা বলেছিস! ঝিনি ভীষণ প্রেমে পড়তে ভালবাসে। ভীষণ। তবে
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মাধব বলে, ঝিনি কখনও তোর প্রেমে পড়ল না কেন বল তো! ইউ ওয়্যার দি মোস্ট এলিজিবল পসিবল লাভার। কিন্তু তোর প্রেমে পড়ল না কেন! আঁ!
ঝিনুক তো তোর প্রেমেও কখনও পড়েনি।
হাঃ হাঃ! দি জোক অফ দি ইয়ার। কিন্তু কথা হল–কী বলছিলাম বল তো! হ্যাঁ, একটা চাকরের কথা। অজ্ঞাতকুলশীল। নিজের পদবিটা পর্যন্ত ছিল না, আমাদের পদবি ধার নিয়ে তবে ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পেরেছিল।
মদন গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে বলে, আজ তোকে নীলুতে পেয়েছে কেন বল তো! মাধব আবার চোখ বোজে। তার অসাধারণ সুন্দর মুখশ্রী বার বার বিকৃত হয়ে যায় এক অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণায়। চোখের কোল ভরে ওঠে জলে। বলে, আজ নয়। সেই কবে থেকে নীলু আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শোওয়ার ঘরে নীলুর ছবিটা টাঙিয়েছিল ঝিনি। আমি কতবার বলেছি। ওটা সরিয়ে দিতে। দেয়নি। মাধব একবার চোখ চেয়ে চারদিক দেখে নেয়, তারপর আবার চোখ বুজে বলে, রাত্রিবেলায়, বুঝলি, রাত্রিবেলায় রোজ নীলু ফটোগ্রাফ থেকে বেরিয়ে আসে! বুঝলি। দ্যাট সারভেন্ট কামস আউট! বাট হি ডাজনট বিহেভ লাইক এ সারভেন্ট! হাঃ হি বিহেভস লাইক এ-এ…
মদন ধীর ও দীর্ঘ এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে নিজেই বোতল থেকে ঢেলে নেয়। মাধবের বোজা চোখ থেকে অবিরল জল ঝরছে। মাঝে মাঝে বিকট হেঁচকি তুলছে সে। ক্লান্ত মাথা সোফার কানায় রেখে দুর্দান্ত একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, কিন্তু চাকরটা আস্পদ্দা আমি বহুবার রেজিস্ট করার চেষ্টা করেছি। আমার দোষ ছিল না। আই ট্রায়েড মাই বেস্ট। ও যখন কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি তখন একবার আমি ওকে দিয়ে আমার তিন জোড়া জুতো পালিশ করিয়েছি, আন্ডারওয়্যার কাচিয়েছি, ইভন একদিন-দু’দিন বাসন পর্যন্ত মেজে দিতে বাধ্য। করেছি। আমি ওকে ভুলতে দিতাম না যে, আফটার অল ও চাকর, অজ্ঞাতকুলশীল অ্যান্ড এ ননএনটিটি।
কিন্তু পারিসনি।
মাধব মাথা নাড়ল, না। ও তো সব হাসিমুখেই মেনে নিত। কোনও ফলস ভ্যানিটি ছিল না। একদিন ও আমাকে বলেছিল, তোমাদের বাড়িতে চাকর খেটে আমার একটা উপকার হয়েছে কি জাননা? আমার অহং বোধট: বাড়তে পারেনি। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল কমপ্লেক্স, চাকর খেটে আমার সেই কমপ্লেক্সগুলো কেটে গেছে।
মদনের একটুও নেশা হচ্ছে না। একটা তীক্ষ্ণধার অনুভূতি তাকে টান টান সচেতন রাখছে, নেশা ধরতে দিচ্ছে না। তবু হুইস্কির প্রতিক্রিয়া তো আছেই। তার সমস্ত শরীর অসহ্য গরম হয়ে উঠছে। জ্বালা করছে কান, নাক, চোখ, মুখ। সে উঠে পাখাটা পুরো বাড়িয়ে দিয়ে আসে।