মাধব আধো-মাতাল গলায় বলল, আয়, আয়। ঝিনুক? না, ঝিনুক ফিরবে না। ঝিনুক কেন ফিরবে বল তো?
মাধব ঘরে ঢুকে দেখে, সেন্টার টেবিলের ওপর একটা বোতল খালি পড়ে আছে, আর একটার সিকিভাগও উড়ে গেছে।
বোস। খা—বলে মাধব একটা গ্লাসে অনেকখানি হুইস্কি ঢেলে বরফের বার থেকে চিমটে দিয়ে তুলে বরফ মেশাল। বলল, দেখ, কী সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছিল ঝিনুক। কত খুঁজে খুঁজে সব জিনিস কিনেছে, কত যত্নে সাজায়, ঘোয় মোছে। কিন্তু তবু ঘর ভেঙে দেওয়া কী সোজা দেখলি? এক মিনিটও লাগে না।
মদন গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে ‘আ’বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঘর ভাঙা যে কত সোজা সে কি তুই আমাকে শেখাবি রে মাধব? আমার চেয়ে ভাল তা আর কে জানে? আজ আমি পার্টিতে রেজিগনেশন দিয়েছি, জানিস?
দিলি? অ্যাঁ!
দিলাম! কেন দিতে হল জানিস? আমার খুব খিদে পেয়েছিল বলে। বাচ্চা ছেলেরা ঘেরাও করেছিল, বেরোতে পারছিলাম না। ওরা বললে, রেজিগনেশন লেটারে সই করলে বেরোতে দেবে। আমি তাই দিয়ে দিলাম। অথচ এই পার্টির সঙ্গে কতকাল আছি! শূন্য গ্লাসটা নামিয়ে রেখে মদন বলে, দে।
অত তাড়াতাড়ি খাস না। হুইস্কি ইজ এ স্লো ড্রিংক।
সো আব অল ড্রিংকস। কিন্তু অত সব প্রােটোকল মানার মেজাজ নেই রে। দে।
আগের বারের বরফের টুকরোগুলো গলবার সময় পায়নি মদনের গ্লাসে। তার ওপরেই আবার হুইস্কি ঢেলে দিল মাধব। মদন উঁকি মেরে দেখল, সেন্টার টেবিলের নীচের থাকে আরও দুটো বোতল বরফের ট্রেতে শোয়ানো। দ্বিতীয় গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে বলে, তুই তো বলেছিলি, ছোট করে হবে। কিন্তু এ যে দেখছি, পুরো শুঁড়িখানা খুলে বসেছিস।
ছোট করেই কথা ছিল। কিন্তু কথা কি রাখা যায়, বল? কথা কি ছিল, এই বয়সে আমাকে একা ফেলে ঝিনি চলে যাবে? বল, দুনিয়ায় কোনও কথা থাকে?
মদন হাত বাড়িয়ে বলে, চিঠিটা দে।
মাধব একটু পিছন দিকে হেলে সভয়ে বলে, কীসের চিঠি?
কেন, ঝিনুক কোনও চিঠি লিখে রেখে যায়নি?
না তো? চিঠি লিখবে কেন? আঁ! চিঠি লেখার কোনও মানে হয়?
চিঠি লিখে রেখে যায়নি তো কী করে বুঝলি যে, ও পালিয়েছে?
বোঝা যায়। দেখছিস না, ঘরদোর কেমন খাঁ খাঁ করছে। অবশ্য তুই ঠিক বুঝবি না। ঝিনির সঙ্গে থাকলে বুঝতিস। আমি তো ঘরে পা দিয়েই
তোদের ঝি-টাকে ডাক।
ঝি? তাকে কেন?
ডাক না।
ওঃ, জ্বালালি। পুনম। এই পুনম।
পুনম দৌড়ে আসে, মামাবাবু, ডাকছ?
মদন জিজ্ঞেস করে, ঝিনুক কখন বেরিয়েছে?
চারটে-পাঁচটা হবে। তখনও রোদ ছিল।
কোথায় গেছে বলে যায়নি?
জি। বোনের বাড়ি। কাছেই।
সঙ্গে কেউ ছিল?
ওই এক মামাবাবু এসেছিল, কী যেন শক্ত নামটা
বৈশম্পায়ন?
জি। আর একটা নতুন কাজের মেয়েও ছিল।
কেন?
বোনের বাড়ি মেয়েটাকে দেওয়ার কথা।
আচ্ছা, তুমি যাও।–বলে মদন মাধবের দিকে চেয়ে বলে, একটি লাথি কষাব তোমাকে শালা।
মাধব মাথা নাড়ে, তুই বুঝবি না। ঝি, বোনের বাড়ি, সব ঠিক। কিন্তু তবে বাড়িটা এত খাঁ খাঁ করছে কেন? তুই টের পাচ্ছিস না?
খাঁ খাঁ নয়। বাড়িটা তোকে বলছে, খা খা আরও হুইস্কি খা।
দূর! এ বাড়ির একটা অদ্ভুত বাতাবরণ আছে! যাকে বলে অ্যাটােসফিয়ার। আজ সেটা অ্যাবসেন্ট। ভীষণরকম ভাবে অ্যাবসেন্ট। আমি অনেক চেষ্টা করলাম খুঁজতে। অ্যাটমোসফিয়ারটা কিছুতেই রেসপন্ড করছে না। ইট ইজ নট হিয়ার।
মদন গ্লাস নামিয়ে বলল, দে।
এবারও তার প্রথমবারের বরফ গলার সময় পায়নি। মাধব চোখ বড় বড় করে বলে, এরকম টানতে কোথায় শিখলে গুরু? আচ্ছা খা। আজ তোরও দুঃখের দিন। আজ থেকে তুইও তো আর এম পি নোস। শুধু মদনা।
চোখ ছোট করে চেয়ে মদন বলে, আমি মদনা সে কথা ঠিক, কিন্তু আমি আর এম পি নই এ কথা তোকে কে বলল?
কেন, এই যে বললি রেজিগনেশন দিয়েছিস?
রেজিগনেশন দিয়েছি পার্টি থেকে, কিন্তু তাতে আমার পার্লামেন্টের মেম্বারশিপ যায় না। আই অ্যাম স্টিল ভেরি মাচ অ্যান এম পি।
মাধব খুব অবাক হয়ে বলে, ইউ আর স্টিল অ্যান এম পি? বাঃ বাঃ। হোঃ হোঃ, আফটার ইভন রেজিগনেশন ইউ স্টিল রিমেন এম পি! বাহবা।
দূর গাড়ল! সংবিধানে আটকায় না।
মাধব উচ্চ স্বরে বলে, আলবত আটকায়। আলবত আটকায়। নিশ্চয় আটকায়।
কোথায় আটকায়?
মাধব মিইয়ে গিয়ে বলে, কোথাও নিশ্চয়ই আটকায়। কিন্তু এক্ষুনি সেটা আমি ভেবে পাচ্ছি না। আফটার অল আমার বউ পালিয়ে গেছে, এখন আমার মাথার ঠিক নেই।
কোথাও আটকায় না। আই অ্যাম স্টিল অ্যান এম পি।
মাধব চোখ বুজে মাথা নাড়ে। বলে, তুই এখনও এম পি কী করে? তা হলে এ ম্যান ক্যান বি ভেরি মাচ অ্যালাইভ আফটার হিজ ডেথ! আঁ। এ ডেড ম্যান মে বি কলড অ্যান অ্যালাইভ ম্যান! না কি লজিকটা হচ্ছে না?
তীক্ষ্ণ কূট চোখে চেয়ে ছিল মদন। বলল, দেয়ার ইজ সাম টুথ ইন ইট।
তার মানে?
মরার পবও কেউ কেউ বেঁচে থাকে। দে।
মাধব বোতলটা তুলে দেখে বলে, ফিনিশ? আঁ। তুই অত ধড়াধ্বড় খাস না। আর একটা খুলছি, এবার সোড়া মিশিয়ে খা।
মদন গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।
মাধব নতুন বোতল খুলে হুইস্কি ঢেলে দিয়ে বলে, কী বলছিলি? মড়া না জ্যান্ত, কী যেন!
বলছিলাম কেউ কেউ মরেও বেঁচে থাকে।
মাধব হঠাৎ সিটিয়ে গিয়ে বলে, যাঃ মাইরি। এমনিতেই আমার ভীষণ ভূতের ভয়। তার ওপর ঝিনি নেই!
মদন এবার সত্যিই খুব আস্তে খায়। ছোট করে একটিমাত্র চুমুক দিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আর একটা সিগারেট ধরায় সে। তারপর বলে, তোর এত ভয় কবে থেকে মাধব? আর কীসেরই বা ভয়!