মণীশ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে হাসল, ও, ওই ব্যাপারটায় তুমি এত রেগে আছ?
চিরু ছলছলে চোখ করে বলে, তোমাকে ওসব উঞ্ছবৃত্তি করতে দেখলে আমার এমন কষ্ট হয়!
আরে দূর! কাপটা না হয় এক্ষুনি ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি।
কাপটা তো বড় কথা নয়। মনটাকে ছুড়ে ফেলতে পারবে কি?
মণীশ মলিন একটু হাসল। বলল, উঁচু দরের সাহিত্যের ডায়ালগ দিলে মিস্টার।
ইয়ার্কি কোরো না। আমি তোমাকে জব্দ করার জন্য কথাটা বলিনি। আজ আমার মনটা খারাপ।
বুঝেছি চিরু। মনটা আমারও ভাল নেই। কেবলই মনে হচ্ছে, সংসার আমার কাছে আরও কিছু চেয়েছিল। মুখ ফুটে চায়নি ঠিকই কিন্তু প্রত্যাশা নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আর সংসার যা চাইছে তা হয়তো আমার দেওয়া উচিত। কিন্তু একটা ভ্রান্ত উচিত-অনুচিত সৎ-অাতের বোধ সব গোলমাল করে দেয়। বুঝি এর কোনও দাম নেই…।
চিরুর আঁচল-চাপা অবরুদ্ধ কান্নার শব্দে থামে মণীশ। গলার কাছে তারও একটা কান্নার দলা ঠেকে আছে বহুদিন। কিন্তু সে তো পুরুষমানুষ! তাই কঁাদল না। একটু হাসল মাত্র। কিন্তু ঠিক করোটির হাসির মতো লাবণ্যহীন দেখাল তার মুখশ্রী।
রান্নাঘরে চৌকাঠে দুই হাত রেখে সে ঝুঁকে পড়ল ভিতরে। চাপা গলায় বলল, বাচ্চারা শুনতে পাবে। কেঁদো না। কান্নার মতো কিছু তো হয়নি।
চিরু কান্না আর আক্রোশে চাপা গলায় ফেটে পড়ল, কথায় কথায় তুমি আজকাল মরার কথা বলো কেন?
বলি আর কিছু করার নেই বলে চিরু। সৎ থাকার চেষ্টা এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, পরের পয়সায় একটা পান খেতে গেলেও দু’বার ভেবে দেখি, এর মধ্যে কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না। অথচ এই নিরন্তর সৎ থেকে থেকেও আজকাল কেমন সততার মধ্যে কোনও শক্তি পাই না।
তোমাকে কেউ অসৎ হতে বলেছে?
মণীশ মাথা নাড়ে, বলেনি, অন্তত তুমি কোনওদিন বলোনি। সে কথা নয়। আমি বলছিলাম সততা, সচ্চরিত্র এগুলোই তো মানুষের শক্তির উৎস। তবু আজকাল আমি সততা থেকে কোনও জোর পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল করেছি। সৎ বলে সারাজীবন মানুষের ঠাট্টা বিদ্রুপ তো কম সহ্য করিনি। আগে গায়ে লাগত না। আজকাল লাগে।
সৎ থেকেও কেউ ভাল নেই?
আছে নিশ্চয়ই। কে খুঁজে দেখেছে বলো? আমার প্রশ্ন তাও নয়। আমি আজকাল সততা জিনিসটা কতদূর প্রয়োজন তাই নিয়ে ভাবি।
ইচ্ছে করলে মদন তোমাকে অনেক কিছু করে দিতে পারে। ওর অনেক ক্ষমতা। তোমাকে সততা বিসর্জন দিতে হবে না।
জানি চিরু। একজন এম পি যে অনেক কিছু পারে তা না বুঝবার মতো ছেলেমানুষ আমি নই। ভেবে দেখো, আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন ও একটুখানি ছেলে। আমাদের বিয়ের পর ওর পইতে হল। সেই শ্বশুরমশাইয়ের অনুরোধে পইতেয় ওকে গায়ত্ৰীমন্ত্র দিয়েছিলাম আমি। বলতে কী আমিই ওর আচার্য। এখন ও হয়তো গলায় পইতেই রাখে না, কিন্তু ব্যাপারটা আমি ভুলি কী করে? সেই মদন এখন এম পি, হাজারজনা এসে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে, সবই জানি। কিন্তু উমেদারদের দলে নিজের নামটা লেখাতে রুচিতে বাধে।
চিরুর কান্না থেমেছে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।
তারপর বলল, আমি তোমাকে আর কখনও কিছু বলব না। বাইরের ঘরে সোফার নীচে বাসন্তী ঘুমোচ্ছ। ওকে ডেকে দাও তো। একটু পোস্ত বেটে দেবে।
মণীশ নড়ল না। তেমনি দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আজ তোমার অভিমান ভাঙিয়ে মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না চিরু। বিবাহিত জীবনের এই প্রথম ফেইলিওর। আমাদের চোখের সামনে মদন এক মস্ত প্রলোভনের মতো। কেবলই মনে হয়, হাতের মুঠোয় একজন ক্ষমতাবান এম পি, ইচ্ছে করলেই কত কাজ আদায় করে নিতে পারি। মনে হয় না চিরু?
চিরু জবাব দিল না। হাতায় করে ভাত তুলে টিপে দেখল।
মণীশ বাইরের ঘরে এসে বাসন্তীকে ঠেলে তুলে দেয়।
জোড়া-দেওয়া কাপটা এখনও তার হাতে। বাতিটা নিভিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে সোফায়। পোযা বেড়ালের গায়ে লোকে যেমন হাত বোলায় তেমনি আদর করে সে কাপটার গায়ে হাত বোলাতে থাকে। একেবারে আস্ত কাপের মতো জোড়া মিলে গেছে। তবু ঠাহর করে আঙুল বোলালে জোড়ের জায়গাটা বোঝা যায়। খুব ঠাহর করলে, নইলে না।
সাবধানে মণীশ কাপটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে দেয়।
অন্ধকারে বসে মণীশ ভাবল, আজ রাতে যদি আমি মরে যাই তা হলে কি সংসার ভেসে যাবে? আমার বাচ্চারা কোনওদিন দাঁড়াবে না? পরের দয়ায় বাঁচতে হবে সবাইকে? যদি তাই হয় তা হলেই বা কী করতে পারে মণীশ? চিরু বা বাচ্চারা তারই বউবাচ্চা বটে, কিন্তু যতদিন বেঁচে আছে। ততদিন। তারপর এই প্রকৃতি, এই দেশ, এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও এই সমাজ থাকবে। কী হবে তা মণীশ জানে না, কী হবে তা স্থির করার মালিক সে তো নয়। তবে সে এটুক বোঝে পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। তাকে ছাড়াও চলবে হয়তো, কিন্তু চলবে। কোনও শূন্যস্থান অপূরণ থাকে না।
মণীশ জানে, মদন হচ্ছে তার হাতের নাগালে এক আশ্চর্য প্রদীপ, যাতে ঘষা মারলেই এক বিশাল দেনেওয়ালা দৈত্য এসে হাজির হবে। কোনওদিনই প্রদীপটাকে ঘষবে না মণীশ। কিন্তু সংসার চাইছে, সে প্রদীপটাকে ঘষুক। একটু ঘষুক।
মণীশ অন্ধকার ঘরে বসে ভাবল, আজ রাতে যদি মরে যাই?
ভেবে একা একা একটু হাসল মণীশ। সেই করোটির হাসিব মতো লাবণ্যহীন এক হাসি। আজ রাতে তার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
.
১৭.
মাধব দরজা খুলতেই মদন প্রথম প্রশ্ন করল, ঝিনুক ফিরেছে?