অনেক দুঃখের কথা বলে কণা বিদায় নেওয়ার পর চিরু মণীশের কাছে এসে বলে, তোমার কি মনে হয়, মদন কিছু করতে পারবে কণার জন্য?
মণীশ নিবিষ্টমনে সিনথেটিক আঠা দিয়ে একটা ভাঙা কাপ জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিল ভিতরের বারান্দায়। বলল, একটা চরিত্রহীন মানুষকে চরিত্রবান করার সাধ্য তো আর ওর নেই। তবে ভয় দেখাতে পারে বটে। চাকরিরও ক্ষতি করতে পারে হয়তো।
তাতে কিছু হবে?
ঠোঁট উলটে মণীশ বলে, আমার মনে হয় না। তা ছাড়া মদনও যে কিছু করবেই এমন ভাবছ কেন? হয়তো দিল্লি গিয়ে ভুলে যাবে। তেমন গা করছিল না।
একটু আনমনা ছিল, আমিও লক্ষ করেছি। ওদের পার্টিতে কী সব গোলমাল চলছে না?
তা চলছে। কাপটা জোড়া দিয়ে দুহাতে জোরসে চেপে ধরল মণীশ, তারপর ওই অবস্থাতেই বলল, শালাবাবু আজ একটু তরল জিনিস চালিয়ে আসবে। মাধবের বাড়িতে নেমন্তন্ন যখন।
কত মাথার কাজ করতে হয়, কত ঝামেলা ওর। একটু খায় খাক। কখনও মাতলামি করে না তো। চিরু ভালমানুষি গলায় বলে।
মণীশ কাপটাকে প্রাণপণে চাপবার চেষ্টা করে। সিনথেটিক আঠার নিয়মে লেখা আছে, অ্যাপলাই ম্যাকসিমাম প্রেশার। দাতে দাত চেপে সে বলে, আমি এক-আধদিন খেয়ে এলে কী করবে?
এসো না! নতুন অভিজ্ঞতা হোক, আমিও মরার আগে নিজের চোখেই দেখে যাই। বলে চিরু চোখ পাকিয়ে তাকায়।
মণীশ মৃদু হেসে বলে, তোমার স্বামী না হয়ে যদি ভাই হতাম চিরু, অনেক অ্যাডভান্টেজ পাওয়া যেত।
চাপটা একটু বেশি হয়ে যাওয়াতেই বোধহয়, কাপের ভাঙা টুকরো দুটো পিছলে খুলে গেল। মণীশ বলল, এঃ। আজকাল কিছুই সহজে জোড়া লাগতে চায় না কেন বলো তো?
ওই ভাঙা কাপ জুড়ে আমার কোন শ্রাদ্ধে সুজ্যি সাজাবে শুনি?
আহা, কত সময় দাড়ি-টাড়ি কামানোর জল নিতেও তো লাগে। থাক না জিনিসটা। এই কাপের এখন চুয়ান্ন টাকা ডজন।
বলে মণীশ আবার আঠা লাগিয়ে ভাঙা টুকরো দুটো জুড়তে থাকে।
চিরু বলে, এ হল পেতনামি। দিন দিন তোমার নজর ভারী ছোট হচ্ছে।
দিন দিন দেশের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে যে। তোমার এম পি ভাইও কথাটা স্বীকার করে। বাজারহাট তো কখনও করলে না মিস্টার, তাই টেরও পেলে না।
চিরু যেন একটু রাগ করেই রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। স্টোভে ভাত ফুটছে, সেইদিকে চেয়ে থাকে চুপচাপ। ছেলেমেয়েরা শোওয়ার ঘরে গুনগুন করে পড়ছে। শব্দটা শুনতে শুনতে কত কী ভাবতে থাকে।
কাপটা অধ্যবসায়ের বলে জুড়তে পেরে যায় মণীশ। বেসিনে আঠা লাগানো হাত ধুয়ে লুঙ্গিতে মুছতে মুছতে খুব সাবধানে রান্নাঘরের ভিতরে উকি দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে, চিরু।
চিরু ঠান্ডা গলায় বলে, বলো।
একটা কথা বলব?
শুনতে পাচ্ছি। বললেই হয়।
তুমি কি রাগ করেছ?
রাগ করা কি আমার সাজে?
রাগের তো সাজগোজ লাগে না মিস্টার।
তবু বাঁদিদের রাগ তো মানায় না।
সেই পুরনো শব্দ। নতুন কিছু ভেবে বার করতে পারো না?
আমার অত মাথা নেই, জানোই তো?
মণীশ চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে, শুধু ইয়ার্কি করে এই গাঢ় মেঘ কাটানো যাবে না। চিরুর সঙ্গে তার বোঝাপড়া চমৎকার তবু মাঝে মাঝে চিরুর একরকম গভীর অভিমান হয়। খুব সামান্য কারণেই হয়। সহজে ভাঙে না।
আবার যখন ‘চিরু’ বলে ডাকল মণীশ তখন তার গলার স্বর পালটে গেছে।
চিরু তবু তাকায় না। গোঁজ হয়ে স্টোভের দিকে চেয়ে থাকে।
মণীশ অত্যন্ত ঘন হয়ে ওঠা গভীর মৃদু স্বরে বলে, যা তোমাকে কখনও বলতে ইচ্ছে করে না। আজ তার কয়েকটা কথা বলব?
চিরুর মনোভাব বোঝা গেল না। কিন্তু সে জবাবও দিল না।
মণীশ মৃদু স্বরেই বলল, এত বয়স পর্যন্ত আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। না একটা বাড়িঘর, না স্থায়ি নিরাপত্তার কিছু না কোনও শখ-শৌখিনতার জিনিস। আশেপাশে সব বাড়িতেই যা যা আছে, তার কিছুই আমার নেই।
চিরু এবার বিস্ময়ভরে তাকিয়ে বলে, এসব কথা উঠছে কেন?
উঠছে তোমার জন্য নয়। আমি আজকাল নিজেই ভেবে দেখি, অনেস্ট থাকার চেষ্টা করে আমি পাঁঠার মতো কাজ করলাম কি না। আমি আজ মরে গেলে কাল যে তোমাদের পঁাড়ানোর জায়গা থাকবে না।
চুপ করো।
মণীশ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, এ রাগ বা অভিমান থেকে বলছি না চিরু। যা ফ্যাক্ট তাই। বলছি। আমি এখন সত্যিই বুঝতে পারি না, এই সমাজের সঙ্গে পাল্লা টেনে চলাই উচিত ছিল কি না।
চিরু নরম হয়েছে। জলচৌকিতে বসে মণীশের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তাবপর বলল, তুমিঅনেস্ট বলে আমি কখনও কিছু বলেছি? না চেয়েছি?
চাওনি? বলোনি। তবু মনে মনে তো মানুষের কত প্রত্যাশা থাকে। তেমন বেশি প্রত্যাশাও নয়। একটু জমি, ছোট বাড়ি, কিছু টাকা, কয়েকটা শৌখিন জিনিস।
চিরু অন্যমনস্ক হয়ে মৃদু স্বরে বলল, মাঝে মাঝে এসব নিয়েও ভাবি, কিন্তু তোমার ওপর রাগ করি না তাই বলে। এই যে কণা এসেছিল, আমার বাড়িঘর দেখেটেখে আজ বলল, তোর বর কাস্টমসের অফিসার, অথচ তোর ঘরে একটাও ফরেন জিনিস নেই। ভারী আশ্চর্য। একটা রেডিয়ো না, টেপ রেকর্ডার না, বিদেশি শাড়ি, সেন্ট ঘড়ি কিছু না। অথচ পাবলিক কত ফরেন জিনিস কিনছে চারদিকে।
শুনে তোমার মন কীরকম হল?
একটু খারাপ লাগল। কথাটা তো মিথ্যে নয়।
মণীশ মাথা নেড়ে বলে, মিথ্যে নয়। তাই ভাবি, অপদার্থতার আর এক নামই সততা কি না।
তা কেন হবে? তবে মদনও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, জামাইবাবুর সততা আর শুচিবাইতে তফাত নেই। সৎ কেন থাকবে না? তা বলে ভাঙা কাপ জোড়া লাগানোর মতো গরিবও তুমি নও।