সহদেব মৃদু স্বরে কথা বলছিল। শোকতাপা মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো গলায়। নব অবশ্য সান্ত্বনা পাচ্ছে না। সহদেব বলল, এ সময়ে পলিটিক্যাল শেলটার দেওয়ার অনেক ঝুঁকি আছে হে নব। আজই পার্টির মিটিং-এ বিরাট ব্যাপার হয়ে গেছে। আজ হোক, কাল হোক, দল ভাঙছে। স্টেট সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, আরও অনেক লিডার রেজিগনেশন দিয়েছে। এখন আমরা রিস্ক নিতে চাই না।
রিস্ক কীসের?
তুমি কনডেমনড খুনি। শেলটার দিলে হাজার রকমের প্রশ্ন উঠবে।
কিন্তু পুলিশ তা হলে আমাকে পালাতে দিল কেন?
সহদেব বিচক্ষণ একটু হেসে বলে, কথাটা দু’বার বললে, ওটা তোমার ভুল ধারণা। পুলিশ তোমাকে পালাতে দেয়নি। কোনও কারণে গার্ডরা অন্যমনস্ক ছিল। তুমি সেই সুযোগটাকেই মনে করছ গটআপ ব্যাপার।
নব কথা না বাড়িয়ে অধৈর্যভাবে কাধ কঁকিয়ে বলে, ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমি কী করব?
গা ঢাকা দিয়ে থাকো যদি পারো।
কতদিন?
যতদিন না ভাঙচুরটা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে।
নিত্যদার কাছে গেলে কিছু হবে?
নিত্যদা খুব ব্যস্ত। আজ রাতেই বোধহয় উনি পার্টির সেক্রেটারি হচ্ছেন। মিটিং চলছে। তোমাকে সময় দিতে পারবেন না।
আমার সঙ্গে পার্টির যে লোক দেখা করেছিল জেলখানায়, যে বলেছিল—
সহদেব সহজে ধৈর্য হারায় না। এখনও হারাল না, মৃদু হাসি হেসে বলে, সে কেন দেখা কবেছে তা সে-ই জানে। দল থেকে তাকে পাঠানো হয়নি।
নব টেবিলে ভর রেখে ঠান্ডা গলায় বলে, আপনি তো জানেন পলিটিক্যাল শেলটার না পেলে পুলিশ আমাকে কুকুরের মতো খুঁজে বের করবেই। এ বাজারে পলিটিক্যাল পার্টি ছাড়া কেউ আমাকে কোনও প্রােটেকশন দিতে পারবে না। আপনি এও তো জানেন সহদেবদা, আমি মাগনা প্রােটেকশন চাইছি না। কোনও শালা কখনও আমার জন্য মাগনা কিছু করেওনি। প্রােটেকশন দিলে কাজ করে দেব, দরকার হলে লাইফের রিস্ক নিয়েই।
কেলো আর বিশে তাকাতাকি করে নেয়। তারপর আবার নবর দিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকে।
সহদেব হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, সবই জানি। কিন্তু শেলটার বা প্রােটেকশন কোনওটাই দেওয়া এখন সহজ নয়। আমাদের সময়টা খারাপ যাচ্ছে।
নব ধৈর্য হারাচ্ছিল। সে বেশিক্ষণ গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। বেশি কথা বলার দমও তার নেই। একটু গরম হয়ে বলে, নীলু হাজরার কেসটায় আমাকে ফাসানো হয়েছিল, আপনি জানেন? নীলুকে আমি মারিনি।
কেলো আর বিশে আর-একবার তাকাতাকি করে, চোখের কোণ দিয়ে সেটা লক্ষ করে নব।
সহদেব নির্বিকারভাবে জিজ্ঞেস করে, কে তোমাকে ফাসিয়েছিল?
নাম বলে লাভ কী? আপনারা তো জানেন।
সহদেব বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, তাতেও আমাদের কিছু করার নেই।
নব একটু হেসে বলে, করার অনেক আছে, কিন্তু আপনারা করবেন না। ঠিক আছে, আমি আমার। রাস্তা করে নেব।
বলে নব ওঠে। সহদেব নিজের হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকে।
বাইরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরা জয় তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে ভয়। ইচ্ছে করলে সে নবর হাত এড়িয়ে এতক্ষণে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে এও জানে, পালিয়ে কোনও লাভ নেই। নব তাকে খুঁজে বের করবেই।
জয় বলল, কিছু হল?
নব রক্তঝরা চোখে চেয়ে বলল, খানকির ছেলেরা ফেঁটা কেটে বোষ্টম সাজছে।
তোমার সঙ্গে জেলখানায় যে দেখা করেছিল তাকে তুমি ঠিক চেনো?
আলবত। শালা কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল!
দু’জনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই পেছন থেকে কেলো বেরিয়ে এসে সোডার বোতল খোলার মতো শিসটানা গলায় ডাকল, নব।
নব ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঘুরে দাঁড়ায়।
কেলো পাহাড়ের মতো দরজায় দাঁড়ানো। কোমরে হাত, এরকম বিশাল চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, শোন।
নব সতর্কভাবে কাছে এগিয়ে যায়, কী বলছ?
কথা আছে।-বলে নবর একটা হাত শক্ত করে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়।
ঘরে এখন সহদেব নেই। শুধু কেলো আর বিশে। বিশের হাতে খোলা ছ’ঘরা রিভলবার।
কেলো রুমাল দিয়ে টাকের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, একটা কাজ আছে। কিন্তু এর মধ্যে পার্টি নেই।
প্যাঁচ মেরো না। কেস করতে হবে তো? বললা। কিন্তু তার আগে বলো, শেলটার দেবে কি না।
কেসটা কর। দেখা যাবে।
তোমাদের কথায় হবে না। আমাকে কোনও লিডারের সঙ্গে লাইন করে দাও।
লিডাররা এর মধ্যে নেই।
সহদেবদা নিজের মুখে বলুক তা হলে।
সহদেবদা বলবে না। আমরাই বলছি। রাজি থাকলে বল, না হয় তো কেটে পড়।
নব করাল চোখে দুই যমজ ভাইকে দেখে নিল। আপাতত তার কিছু করার নেই। তারা উভয়পক্ষই যে দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় তাতে কেউ কাউকে ফালতু ভয় খেয়ে সময় বা শরীর নষ্ট করে না। কাটে কাটে পড়ে গেলে কে কার লাশ নামাবে তার কোনও ঠিক নেই। তবে নব একটু টাইট জায়গায় আছে বটে। সে বলল, ফালতু বাত ছাড়ো কেলোদা, কেস আমি করে দেব, সে তোমরা জাননা। কিন্তু তারপর কী?
কেলো নির্বিকারভাবে বলে, কেস হয়ে গেলে বাড়ি গিয়ে বসে থাকবি।
বাড়িতে লালবাজারের খোঁচড়েরা নেই?
অন্য জায়গায় তোর ঠেক আছে?
আছে।
তা হলে সেইখানেই চলে যা। পরশু পার্টি অফিসে দুপুরের পর দেখা করিস।
কিছু মালকড়ি ছাড়ো কেনোদা।
কেলো একটু হাসল, তুই মালকড়ি ছাড়া নড়বি না তা জানি। বোস, ব্যাপারটা বুঝে নে। সঙ্গের ছোকরাটা কে?
ফালতু। কেলো একটু গম্ভীর মুখ করে মোটা আঙুল মুখে পুরে সঁতের ফাঁক থেকে বোধহয় দুপুরের খাওয়া মাংসের আঁশ বের করে আনল। তারপর চোখ ছোট করে বলল, বিশে বলবে। শুনে নে।
১৬. অনেক দুঃখের কথা
১৬.