মদনকে দেখে দু’পা এগিয়ে এসে স্নান একটু হেসে বলল, দু’ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
ভিতরে গিয়েই তো বসতে পারতে।
ভিতরে অনেক লোক। জায়গা নেই। আমি আজই দিল্লি রওনা হচ্ছি।
গৌরীর আজ দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মদন সে কথা জিজ্ঞেস করল না। গৌরী কেন পালাচ্ছে তা সে খানিকটা জানে। শুধু বলল, একা পারবে?
পারব। গরিবরা সব পারে।
গিয়ে কোথায় উঠবে?
আমার এক দূর সম্পর্কের দিদি থাকে কলকাজির কাছে। সেখানে উঠব।
বাচ্চারা?
নিচ্ছি না। দিদির বাসায় কীরকম রিসেপশন পাব জানি না তো! বাচ্চারা সঙ্গে থাকলে অসুবিধে।
মা ছাড়া ওদের অসুবিধে হবে না?
ওরা মাকে থোড়াই কেয়ার করে।
তোমার কষ্ট হবে না?
গৌরী একটু হাসল, মানুষ তো! একটু হবে! তবে সেটা সহ্য করা যাবে। ওসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে আপনি ভাবলেন না। আমি এখন পালাতে চাই। পরে সুযোগ-সুবিধে বুঝে ছেলেমেয়েকে নিয়ে যাব।
চারদিকে আজকাল খুব বউ পালাচ্ছে। খুব দুশ্চিন্তার কথা। মদন ফিচেল হাসি হেসে বলে, আর নবর জন্য মন কেমন করবে না? নব যদি বাড়ি ফিরে দেখে, তুমি নেই, তা হলে?
গৌরী কেমন বিবশ হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কার জন্য এতকাল মন কেমন করেছে তা কি এম পি সাহেব জানেন?
না। কার জন্য গৌরী?
দিল্লিতে গিয়ে বলব।
নবর কাছে আর কখনও ফিরে আসবে না গৌরী?
নব আমার কে? ওর কাছে ফিরে আসব কেন?
নব যদি ভাবে তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে গেছ?
আমি কার সঙ্গে পালালাম তাতে ওর বড় বয়েই গেল।
তা ঠিক। তবে প্রেস্টিজের ব্যাপারও তো আছে। বউ পালালে কোনও পুরুষ খুশি হয়?
আমি তো চাকরি করতে যাচ্ছি। পালাচ্ছি কে বলল?
তুমিই তো এইমাত্র বললে!
সে আপনার কাছে সত্যি কথাটা বললাম, ওর বাড়ির লোক অন্যরকম জানে।
মদন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গেল।
গৌরী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, কিচ্ছু জটিল হয়নি মদনদা। এটাই সবচেয়ে ভাল হয়েছে। আপনি চলে আসার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম।
মদন ফিচিক করে হেসে বলে, বুড়ি তোমাকে খুব ধোয়াচ্ছিল।
আপনিই তো দুষ্টুমি করে লাগিয়ে দিয়ে এলেন। তবে ওসব শুনতে শুনতে আমার অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ সব অন্যরকম হয়ে গেল। পাষাণী অহল্যাকে জাগাতে রামচন্দ্র এলেন। আজ আপনি যেই গেলেন অমনি ভিতরে সব ঘুমন্ত বোধ জেগে উঠল। দুঃখ, অপমান, হতাশা, সেইসঙ্গে ভালভাবে বাঁচার ইচ্ছে। অন্ধকারে থেকে থেকে আলোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ আলো দেখে বুঝতে পারলাম, কী অন্ধকারেই না পড়ে আছি।
আমি কি তোমার আলো গৌরী? আবার রামচন্দ্রও?
গৌরী এই প্রকাশ্য ফুটপাতে, চারদিকে চলন্ত লোকজনের ভিড়েও কেমন বিহ্বল হয়ে গেল। আবেগে ঠোঁট কাপল, গলা রুদ্ধ হয়ে গেল। কোনওক্রমে বলল, আলো! আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনও আলো নেই।
এ কথায় খুব হোঃ হোর করে হাসতে ইচ্ছে করছিল মদনের। বদলে সে আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বলল, তোমার জীবনে আর একটা আলো ছিল গৌরী। আমি জানি।
গৌরীর স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখ থেকে স্বপ্নের ক্রিমটুকু কে মুছে নিল। একটা ঢোক গিলল সে। মাটির দিকে চেয়ে বলল, আপনি কখনও অতীতকে ভোলেন না কেন এম পি সাহেব?
মদন তেতো একটু হেসে বলে, ভুলতে পারি না গৌরী। আমার যে কেন সব মনে থাকে! আর তার জন্যই মাঝে মাঝে কষ্ট পাই।
গৌরী যখন মুখ তুলল তখন তার চোখ ছলছল করছে। একটু ধরা গলায় বলল, আপনি কি এখনও নীলুকে হিংসে করেন? আমার জন্য?
মদন গম্ভীর গলায় বলে, নীলুকে হিংসে করব কেন গৌরী? নীলুর এমন কী ছিল যাকে হিংসে করা যায়?
গৌরী মাথা নেড়ে বলল, আমিও তো তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। নীলু কোনওদিন আমাকে ফিরেও দেখেনি। নীলুকে কেন আপনি হিংসে করবেন?
মদন মাথা নেড়ে বলে, নীলুকে হিংসে করি না গৌরী, শুধু জীবনের সত্য দিকগুলির দিকে তোমার চোখ ফিরিয়ে দিতে চাই। তোমার জীবনের আলো ছিল নীলু। বিয়ে করার জন্য তাকে তুমি অনেক জ্বালিয়েছ। বিষ খাবে বলে ভয় দেখিয়েছ। নীলুর ওপর শোধ নিতেই কি তুমি নবর সঙ্গে ঝুলেছিলে? নীলু অন্তত তাই বলত।
ওসব কথা থাক মদনদা। আজ থাক। নীলু তো বেঁচে নেই।
মদন একটু হাসল, আস্তে করে বলল, কিংবা হয়তো খুব বেশি বেঁচে আছে।
নীলুর জন্য আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে মদনা, সে আমার আলো হবে কেন?
মদন চুপ করে রইল। মুখটা গম্ভীর।
গৌরী হঠাৎ নিচু হয়ে তাকে একটা প্রণাম করে বলল, আমার গাড়ির সময় হয়ে গেছে। আমি আসি।
টিনের সুটকেসটা তুলে নিয়ে গৌরী নিরাশ্রয় অসহায়ের মতো যখন রাস্তাটা পেরিয়ে গেল তখন মদনের ভারী কষ্ট হল গৌরীর জন্য।
এতক্ষণ এম পি ছিল না মদন, দিদির বাসার বাইরের ঘরে পা দিয়েই হল। কণা নামে একজন মহিলা বসে আছেন। স্বামী দুশ্চরিত্র। ঘ্যানর ঘ্যানর অনেক কথা শুনে যেতে হল তাকে। আশ্বাস দিল গিয়েই ব্যবস্থা করবে।
সারাক্ষণ ভারী ক্লান্ত লাগছে তার। স্কচের বোতল খুলে বসে আছে মাধব। গিয়ে এক্ষুনি ড়ুব দিতে হবে। সব ভুলে যেতে হবে, ভাসিয়ে দিতে হবে। সে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। তারপর জামাকাপড় পালটে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরল একটা।
.
সহদেব বিশ্বাস তার ওকালতির চেম্বারে চেয়ারে হাঁটু তুলে বসা, মাথায় টাক, মুখে ক্ষুরধার বিষয়বুদ্ধি। খুব পসারের সময়েই ওকালতি ছেড়ে দিয়েছে। এখন কালেভদ্রে উপরোধে বা পার্টির দরকারে কেস করে। তার চেয়ারের দু’ধারে কেঁদো বাঘের মতো দুই রুস্তম বসে আছে। তাদের গায়ের টি শার্ট ছিড়ে শরীরের মাসল ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুগুরের মতো হাত, খোলা জামা দিয়ে বুকের ঘন লোম দেখা যাচ্ছে। দু’জনেরই চোখ নবর দিকে স্থির। দুজনকেই চেনে নব। বেলেঘাটার বিখ্যাত মস্তান যমজ দুই ভাই কেলো আর বিশে। দিনকাল পালটে গেছে, এখন মস্তানরা লিডারদের দেখে, লিডাররা দেখে মস্তানদের। কিন্তু ফালতু ব্যাপারে নবর মনোেযাগ দেওয়ার সময় নেই। তিন জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে সে সহদেব বিশ্বাসের কাছে আসতে পেরেছে।