ঝিনুক ছলছলে চোখ তুলে বলে, সত্যি?
বৈশম্পায়ন একটু থমকাল। ঝিনুক যেভাবে চেয়ে আছে তাতে মনে হয় সে বৈশম্পায়নের নদীটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা পরিণতবুদ্ধির মহিলার পক্ষে যেটা খুব স্বাভাবিক নয়।
একটু থেমে বৈশম্পায়ন বলে, দু’ধারে খুব উঁচু উঁচু পাহাড়। ভীষণ সাদা, শূন্য এক উপত্যকা, সেইখানে এলোচুল বিছিয়ে নদী সারাদিন গুনগুন করে গায়। সাদা সাদা ঠান্ডা পাথর ছড়িয়ে পড়ে আছে চারদিকে। অদ্ভুত না ঝিনুক? শুনলে লোকে আমাকে পাগল ভাববে!
ঝিনুক মাথা নেড়ে বলে, মোটেই না।
বৈশম্পায়ন একটু হতাশ হয়। এত সহজে আর কেউ নদীটাকে মেনে নেবে এরকম আশা সে করেনি। সে বলল, তোমার অদ্ভুত লাগছে না?
না তো! এরকম হতেই পারে।
বৈশম্পায়ন খুবই অবাক হয়ে বলে, হতে পারে?
নীলু যখন মারা গেল তখন কিছুদিন আমারও মৃত্যুর হাওয়া লেগেছিল।-বলে একটু আনমনা হয়ে গেল ঝিনুক। একটু চুপ করে থেকে গলাটা এক পরদা নামিয়ে বলল, জানেন তো, নীলুকে আর আমাকে নিয়ে একটা বিচ্ছিরি কথা রটেছিল!
বৈশম্পায়ন একটু চমকে উঠে বলে, তাই নাকি?
খুব বিচ্ছিবি। যতদূর নোংরা হতে হয়। সেটা রটিয়েছিল আমার এক দূর সম্পর্কের ননদ।
কী রটিয়েছিল ঝিনুক?
ঝিনুক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, একজন ছেলের সঙ্গে একজন মেয়েকে জড়িয়ে যা রটানো যায়। অবশ্য নীলুর সঙ্গে আমার খুব বনত। বিয়ের পর নতুন নতুন শ্বশুরবাড়িতে কাউকেই তেমন ভাল লাগত না। একমাত্র নীলু, কী নরম, কী ভদ্র, কী বুদ্ধি! বেঁচে থাকলে নীলু সবাইকে ছাড়িয়ে যেত। এক এক সময়ে তো আমার মনে হত, নীলু একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রীও হবে।
বৈশম্পায়ন মাথা নাড়াল, নীলু ছিল এক্সেপশনাল, আমি জানি।
তা হলেই বলুন! নীলুকে ভাল না বেসে পারা যায়? কিন্তু ভালবাসা মানেই কি খারাপ কিছু? আমি নীলুর সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে গেছি, ছবির একজিবিশন দেখেছি, সারা রাত ক্লাসিকাল গানের আসরে গান শুনেছি, এতে কি দোষ? অথচ
এতদিন বাদেও অভিমানে একবার ঠোঁটদুটো ফুলে উঠল ঝিনুকের। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো ভীষণ অদ্ভুত। আমাকে একদম সহ্য করতে পারত না, আমি সুন্দর বলে। আর নীলুকেও সহ্য করতে পারত না। কেন জানেন? নীলু ভীষণ ব্রাইট বলে। ওদের ধারণা ছিল নীলু সম্পর্কে সবাই নাকি বাড়িয়ে বলে।
মাধব নীলুকে খুব ভালবাসত। বৈশম্পায়ন বলে।
বাসত কি না কে বলবে! আসলে নীলুর যেটুকু সম্পর্ক ছিল বাড়ির সঙ্গে তা আমার জন্যেই। নইলে নীলুর তখন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা। ও আমাকে প্রায়ই বলত, পায়ে হেঁটে সারা ভারতবর্ষের গ্রামে গঞ্জে শহরে ঘুরে বেড়াবে। বলত, দেশের প্রবলেমগুলো ধরতে হবে বউদি, অনেক মানুষের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে হবে, এই বুকের মধ্যে সব মানুষকে আমার টেনে নিতে ইচ্ছে করে।
বৈশম্পায়ন চুপ করে থাকে। প্রসঙ্গটা অস্বস্তিকর।
ঝিনুক রেলিং-এ আর একটু ঝুঁকে বলে, আমার শ্বশুরবাড়ির কাছেই নীলু খুন হল সন্ধেবেলায়। উঃ, সে কী সাংঘাতিক কাণ্ড! তরতাজা, ছটফটে, ভীষণরকমের জ্যান্ত নীলু মরে গেছে, ভাবা যায়! তিনদিন আমি একদম বোবা হয়ে ছিলাম। কথা বলতে গেলে মুখ দিয়ে কেবল বুবু শব্দ বেরোত। তারপর থেকেই একটা মৃত্যুর হাওয়া এল। ঘরে বসে থাকতাম, মনে হত বাইরে হঠাৎ একটা হাওয়া। ছেড়েছে। আর সেই হাওয়া কী যেন বলতে চাইছে আমাকে। দৌড়ে যেতাম বাইরে। ছাদে বসে আছি, হঠাৎ মনে হল আমার চারদিকে যেন বাতাসটা ভারী হয়ে ঘুরছে, কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। এক এক সময়ে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত, মনে হত, একটা হাওয়া এসে আমার দরজায় জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে, ডাকছে, বউদি। বউদি।
এ কি ভৌতিক কিছু ঝিনুক?
না, না, একদম তা নয়। আসলে আপনার ওই নদীর মতোই এও এক মৃত্যুর হাওয়া। বেঁচে থাকতে আর মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে অত ভালবাসত নীলু, অথচ সে-ই তো মরে গেল! তাই বোধহয় এই হাওয়াটা এসে আমাকে বলতে চাইত, তোমরা কেন বেঁচে আছ? তোমাদের বেঁচে থাকার কী অধিকার? যে পৃথিবীতে নীলু থাকতে পারল না, সেই পৃথিবীতে তোমরাই বা থাকবে কেন? জানেন, সেই সময়ে আমার বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে ইচ্ছে হয়েছে।
বৈশম্পায়ন আস্তে জিজ্ঞেস করল, নীলু সম্পর্কে তুমি কি সবটুকু জানো ঝিনুক?
ঝিনুক স্থির হয়ে সামনের নির্মীয়মান একটি ফ্ল্যাটবাড়ির কাঠামোর মধ্যে ঘনীভূত অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল, নীলুর সবটুকু কে-ই বা জানে! তবে ও মরে যাওয়ার পর আমার যখন ওরকম মানসিক অবস্থা, তখন একদিন খুব বিরক্ত হয়ে মাধব বলেছিল, নীলু ওর ভাই নয়।
বৈশম্পায়ন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ঝিনুক জানে।
ঝিনুক মাথা নুইয়ে বলে, জানলাম নীলু ওদের বাড়িতে সেই ছোট্টবেলায় এসেছিল। চাকরের কাজ করত। বাপের পদবি জানা ছিল না বলে মাধবদের পদবি নেয়। একটু বড় হওয়ার পর যখন দেখা গেল যে, সে অত্যন্ত মেধাবী আর বুদ্ধিমান তখন মাধবদের বাড়ির লোকেরা ওকে বাড়ির ছেলে হিসেবে পরিচয় দিত। পরে সে বাড়ির ছেলেই হয়ে ওঠে। মাধব আজও নীলুকে ভাই বলে মানে। এসব জানি মন্টু।
.
১৫.
দিদির বাসার সামনে ফুটপাথে গৌরী দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, টিনের সুটকেসটা পাশে নামানো।