নীলুর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে ঝিনুককে বহুক্ষণ ধরে দেখে নেয় বৈশম্পায়ন। এই এক মুখ। দেখতে দেখতে মৃত্যু ভুল হয়ে যায়, জীবনের তুচ্ছতাগুলির কথা মনে পড়ে না, দুঃখবোধ থাকে না। বুক ভরে ওঠে আনন্দে।
সে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে, এ কি কাম? এ কি পাপ? এ কি বিশ্বাসঘাতকতা?
মাধবের য়খন বিয়ে হয় তখন বৈশম্পায়ন ভবলিউ বি সি এস পাশ করে বাঁকুড়া জেলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি করছে। আজও সেই চাকরি করে যেতে পারলে ভাল হত। ঝিনুকের সঙ্গে ফিরে দেখা হত না।
কিন্তু এ কেবল ইচ্ছাযুক্ত চিন্তা। দেখা হতই। দেখা না হলে হত কী করে? আরও কয়েকটা জেলা মহকুমা ঘুরে প্রোমোশন পেয়ে এই কলকাতাতেই আসতে হত তাকে। তার আগেই অবশ্য সে এল। আলিপুরদুয়ার কোর্টে গণধোলাইয়ের পর কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ভাঙা হাত আর জখমে শক্ত হয়ে ওঠা ঘাড় নিয়ে সে কলকাতায় চলে এল পাকাপাকি। একটা ব্যাঙ্কে বরাতজোরে চাকরি জুটে গেল। এ সবই নিয়তিনিদিষ্ট, আগে থেকে ছক বাঁধা।
শর্মিষ্ঠা এসে বলল, শরীর কেমন লাগছে?
ভাল। অনেকটা ভাল।
আর একটু বসবে?
বসলে ভাল হয়। ওরা কি ফিরবে?
ঝি তো বলছে ফিরবে।
একটু বসি। ওরা ফিরলে উঠব।
বুবুমের ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম পাড়িয়ে দাও।
আজ আর পুজোর বাজার হবে না মনে হচ্ছে।
তুমি একা গিয়ে কিনে আনো না।
এতে একটু সতেজ হয়ে শর্মিষ্ঠা বলে, যাব? বুবুমকে কে দেখবে?
দেখার কী? আমি বসে থাকব, ও ঘুমোবে।
দোনোমোনো করে শর্মিষ্ঠা বলে, তোমার মায়ের কাপড় যদি তোমার পছন্দমতো কিনতে না পারি?
পারবে।
ঠকে আসলে বকবে না?
মেয়েরা একটু তো ঠকেই। আজ কিছু বলব না। যাও।
কার জন্য কী যেন?
জয়ের জন্য একটা ভাল প্যান্টের পিস আর শার্টের কাপড়।
প্রতিবারই জয়কে দিচ্ছ। এখন তো চাকরি করে।
ও চাকরিতে কী হয়! এনো। সংসারে যখন থাকি না তখন তার কমপেনসেশনও কিছু দিতে হয়।
সংসারের সঙ্গে আজকাল কেউ থাকে না। ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখো।
ও শর্মিষ্ঠা!
টাকা দাও।
কত লাগবে?
হাজার খানেক দিয়ে রাখা।
বুবুমকে ঘুম পাড়িয়ে যাও। বলে চোরা পকেট থেকে টাকা বের করে বৈশম্পায়ন।
শর্মিষ্ঠা ব্যাগে টাকা রেখে ছেলের কাছে যেতে গিয়ে ফিরে বলে, চা খাবে?
ওরা ফিরুক।
ওদের সঙ্গে তোমার কী? ঝি করে দেবে।
তা হলে করতে বলল।
শর্মিষ্ঠা চলে গেলে বৈশম্পায়ন চোখ বোজে। সাদা হিম নুড়ি-পাথর ছড়ানো উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর নদী। কী অদ্ভুত গান।
শর্মিষ্ঠা চলে যাওয়ার পর বেডরুমের পাশের লিভিং রুমে ফোনটা বাজল।
উঠে গিয়ে ধরে বৈশম্পায়ন।
মাধব আছে?
না।
আপনি কে?
আমি ওর এক বন্ধু!
আমি মাধবের বন্ধু। আপনি কে বলুন তো। নামটা কী?
আমি বৈশম্পায়ন।
যাঃ বাব্বা! না মশাই হল না, আমরা কমন ফ্রেন্ড নই।
এরকম হতেই পারে। বৈশম্পায়ন খুব ভদ্র গলায় বলে।
ওর সঙ্গে কি আপনার দেখা হবে?
হতে পারে। আমি ওর জন্যই বসে আছি।
একটু কাইভলি বলবেন কাল সকালে ওর বন্ধু মদন আসছে! ও চিনবে। মদন এম পি।
মদনকে আমিও চিনি।
যা বাব্বা! তবু আমি আপনাকে চিনতে পারছি না কেন?
ফোনের ভিতর দিয়েই ওপাশ থেকে একটু মদের গন্ধ পায় বৈশম্পায়ন।
.
০২.
শিয়ালদা মেন স্টেশনের ছ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গেটের বাইরে ফরসা মতো একটা লোক খুব মাতব্বরি চালে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছিল। টিকিট নেওয়ার কালো কোট দুজন থাকা সত্ত্বেও ভিড়ের ঠেলায় যাত্রীরা বেরিয়ে আসছে বেনোজলের মতো, কে কাকে টিকিট দেয়। এই লোকটা সেই ছিটকে আসা যাত্রীদের দু চারজনের দিকে হাত বাড়িয়ে টুকটাক টিকিট নিয়ে পকেটে ভরছে।
দার্জিলিং মেল লেটে আসছে। অনেকক্ষণ বাইরের চাতালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল জয়। তার প্রথমে তেমন কিছু মনে হয়নি। ভেবেছিল কালো কোট খুলে রেলের টিকিটবাবুই টিকিট নিচ্ছে। খানিকক্ষণ দেখে-টেখে সন্দেহ হল, করাপশন।
জয়ের বড় জামাইবাবু বলেছিলেন, অন্যায় দেখলেই ফরম্যালি হলেও একটা প্রতিবাদ সবসময়ই করে রেখো। কাজ হোক বা না হোক বড় জামাইবাবু সর্বদাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে থাকেন। তাতে যে বড় জামাইবাবুর খুব ভাল হয়েছে তা নয়। বরং প্রোমোশন হয়নি, মেয়েরা যে যার ইচ্ছে মতো বিয়ে করেছে, তিন ছেলেই আগাপাশতলা দুর্নীতিগ্রস্ত, বড়দির সঙ্গেও বড় জামাইবাবুর বনিবনা। নেই। তবু জয় বড় জামাইবাবুর এই একটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।
দু দুটো লোকাল ট্রেনের পর প্ল্যাটফর্ম এখন ফাঁকা। করাপটেড লোকটা সাত নম্বরের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছে।
ও মশাই শুনুন। জয় লোকটাকে ডাকে।
লোকটা নিমীলিত চোখে চায়। চোখ দুখানা বড় বড়, ডাগর, মুখও ভদ্রলোকের মতো, রং ফরসা তবে গায়ের জামাপ্যান্ট ময়লা। লোকটা ঠোঁট থেকে একটা মাছিকে উড়িয়ে বলল, কিছু বলছেন?
আপনি কি টিকিট কালেক্টর?
আজ্ঞে না।
তবে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছেন যে!
লোকটা একথায় সুড়ুক করে কাছে সরে আসে, তখুনি এই সাত সকালেও লোকটার মুখ থেকে ভক করে মদের গন্ধ পায় জয়। লোকটা গলাটা ছোট করে বলে, চুরি ছিনতাই করি না। টিকিটে চার আনা করে হয়। খারাপ কিছু করছি দাদা? মনে কিছু করলেন?
জয় কঠিন হওয়ার চেষ্টা করেও পারে না। সে ভারতবর্ষের একটি বড় পার্টির দক্ষিণ কলকাতার একজন মেম্বার। সে দুর্নীতি রুখতে অনেক কিছুই করতে পারে বলে তার ধারণা। যদিও এই রাজ্যে তার দলের কোমরের জোর তেমন নেই, তবু তামাম দেশে তো তার দলই এখন খেলছে। এই লোকটাকে ইচ্ছে করলেই সে ধরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু একটু মায়া হল। বয়সও বেশি নয়। ত্রিশের নীচেই।