শ্ৰীমন্ত! কী ব্যাপার?—হরি গোঁসাই খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করে।
শ্ৰীমন্ত একবার বাঘা-চোখে তাকায়। বাবারে, কী চোখ! লাল, জ্বলজ্বলে আগুনে। শ্ৰীমন্ত বিগড়োলে খুব গড়বড়, সবাই জানে। হরি গোঁসাই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস পেল না।
জিপের লোকটা শ্ৰীমন্তর হাতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, একটা সিকুইল খেয়ে নিস। এখন বাড়ি গিয়ে বসে থাক। সন্ধের পর যাব।
জিপের লোকটাকে জয় আবছা চেনে। কালো, পেটানো চেহারা, মাথায় টাক, বছর চল্লিশেক বয়স। পরনে খুব ঝা চকচকে প্যান্ট আর দামি হাওয়াই শার্ট। শ্ৰীমন্তর হাতে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর সে একবার খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চাউনিতে জয় আর হরি গোঁসাইকেও দেখল।
শ্ৰীমন্ত রাগে ফুসছে। গলার শিরা ফুলে আছে, চোখে সেই খ্যাপা দৃষ্টি। বলল, মা কালীর দিব্যি বলছি নদুয়াদা, হেলার লাশ আমি নামাব। না হলে নাম পালটে রেখো।
নদুয়া নামের লোকটা সাপের মতো একটা হিসস শব্দ করে গালের পানটা একটু চিবিয়ে নিয়ে বলল, রি-অরগানাইজেশন হচ্ছে। তখন দেখা যাবে। এখন বাড়ি যা।
শ্ৰীমন্ত একবার পার্টি অফিসের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে থাকে।
পিছনে সঙ্গ ধরে হরি গোঁসাই। জয় এগোয় না। কয়েক পা সরে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। নদুয়াকে সে চেনে। এর গোডাউন থেকে কয়েক বছর আগে বন্যার সময় মদনদা গম বের করেছিল। গমের মাপ নিয়ে খুব লেগেছিল মদনদার সঙ্গে। নদুয়া বলেছিল, রিলিফের জিনিস আর মাপব কী, ওরকম নিয়ম নেই। যে মাপ বলে দেব সেইটেই ঠিক মাপ। কিন্তু মদনদা ছাড়েনি। বলেছে সরকার যখন দাম দেবে তখন গুনে নেবেন না? তখন চোখ বুজে থাকবেন? শেষ পর্যন্ত দলের ছেলেরা গুদাম ঘেরাও করার ভয় দেখানোয় সব মাল মাপা হয়েছিল। বিস্তর কম ছিল ওজনে। এ সেই লোক। সম্পূর্ণ করাপটেড। তবে পলিটিক্যাল লাইন আছে, টাকা আছে, জিপ গাড়ি আছে, গুন্ডা আছে। শিয়ালদার যে করাপটেড লোকটা যাত্রীদের কাছ থেকে ভড়কি দিয়ে টিকিট নিচ্ছিল তাকে ধমকানো যত সোজা একে ধমকানো তত সোজা নয়। লোকটা বুকে হাত রেখে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ রাখছে। জিপে ড্রাইভার বসা। প্রস্তুত। মনে হচ্ছে কাউকে তুলে নিয়েই হাওয়া হবে। কাকে তা অবশ্য জয় জানে না!
এত গোলমালে জয়ের মাথা ধরে গেছে; মনটা বড় ভার। মাত্রই সে বিভিন্ন জায়গায় পার্টির বক্তৃতা দেওয়ার সুযোেগ পেতে শুরু করেছে। হিঙ্গলগঞ্জে দলের সংগঠনে তাকে পাঠানোর কথা হচ্ছিল। দু-চার বছর পরেই সে অ্যাসেমব্লির টিকিট পেয়ে যেত। মদনদার মতো করেই নিজেকে তৈরি করছিল সে। আয়না দেখে দেখে বক্তৃতা দেওয়া এবং সেই সঙ্গে নানারকম এক্সপ্রেশন দেওয়া প্র্যাকটিস করছিল। গলার ওঠা-নামা, হাততালির জন্য ঠিক জায়গায় জুতসই আবেগকম্পিত ভাবালু কথা লাগিয়ে তুঙ্গে উঠে যাওয়া, এ সবই অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল তার। স্বয়ং ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি ক’বার পিঠ চাপড়ে বলেছেন, তুমি বেশ তৈরি হচ্ছ। কিন্তু হঠাৎ এ হল কী? পাটি যে ভাঙবে তা সে নিজেদু’ মাস আগেও কেন জানতে পারেনি?
হরি গোঁসাই ফিরে এসে বলল, চল।
শ্ৰীমন্তদার সঙ্গে কথা হল?
হল। চল, বলছি।
একটু এগিয়ে গিয়ে হরি গোঁসাই বলে, শ্ৰীমন্ত মদনার কাজ ছেড়ে দিয়েছে।
কেন?
তা বলল না। শুধু বলল, অনেক ব্যাপার আছে।
কবে ছাড়ল? কালও তো আঠা হয়ে লেগে ছিল সঙ্গে।
কবে ছাড়ল জেনে কী হবে? আজকাল হকে নকে এ ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
জয় গভীর মুখে একটু ভাবল। তারপর বলল, শ্ৰীমন্তদা ছাড়বে জানতাম।
কী করে জানলি?
হাবভাব দেখে। কদিন আগে আমাকে একবার কথায় কথায় বলেছিল, মদনদার বেস ওয়ার্ক ভাল হচ্ছে না। স্টেট লিডাররা নাকি মদনদার ওপর খুশি নয়। তখনই সন্দেহ হয়েছিল, শ্ৰীমন্তদা গোপনে অন্যদিকে তাল দিচ্ছে। শ্ৰীমন্তকে যারা ম্যানহ্যান্ডেল করল তারা কারা জানো? মদনদার লোক নয় কিন্তু।
না, মদনদার লোক হবে কেন? হেলার নাম শুনলি না? হেলা হচ্ছে নিত্য ঘোষের
জানি জানি।–ধৈর্য হারিয়ে জয় বলে, কিন্তু তাই বা হয় কী করে? শ্ৰীমন্তদা মদনদাকে ছেড়ে দিলে আর একটা গ্রুপে তো তাকে ভিড়তে হবে। সেই গ্রুপটা তো নিত্যদার। তা হলে নিত্যদার লোক ওকে মিটিং থেকে বের করে দেবে কেন?
বুঝতে পারছি না। এখন বাড়ি চল।
গিয়ে?
গিয়ে আবার কী? এখন কেটে পড়াই ভাল।
মদনদা একা রইল যে! যদি কিছু হয়?
কিছু হবে না।
আমাদের দেখা উচিত।
দেখে লাভ নেই। মদনদাকে দেখার লোক আছে। চলল।
হরি গোঁসাইয়ের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জয় বলে, আমার মনে হয় কী জানো? দলে ভাল লোক কেউ থাকবে না।
হরি গোঁসাই চিন্তিত মুখে বলে, তাই তো দেখছি। মদনদা যদি পাওয়ারে না থাকে তবে বিশুটাকে মেডিক্যালে দেওয়া হয়ে গেল। ওদিকে এই সময়ে নবটাও জেল থেকে বেরিয়েছে। কীযে হবে!
সারা পথ জয় সেই অতীতের সুদিনের কথা ভাবতে ভাবতে এল। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। তার মধ্যে রড ধরে তেড়াবেঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল, সেই কবে পালবাজার অবধি একটা সাইকেলে ডবলক্যারি করেছিল তাকে মদনদা। একটা মিটিং সেরে ফিরছিল তারা। রডে বসে মদনদার শ্বাস নিজের ঘাড়ে টের পেতে পেতে, আর এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ঝাকুনি খেতে খেতে বারবার মনে হয়েছিল, মদনদা একদিন খুব ওপরে উঠবে! সেজদিকে খুব পছন্দ ছিল মদনদার। সেজদিরও মদনদাকে। বাড়িতে এলেই সেজদির সঙ্গে ছাদে গিয়ে পুটর পুটর কথা বলত। জয় টের পেয়ে আনন্দে কণ্টকিত হয়েছে কতবার। মদনদা যদি সেজদিকে বিয়ে করে তো কী দারুণ হয়! হয়নি কেন তা জানে না জয়। একদিন এক পলিটেকনিক পাশ সরকারি চাকরের সঙ্গে সেজদির বিয়ে হয়ে গেল! মদনদা তার বছর চারেক বাদে এম পি হয়।