নব বড় রাস্তার কাছাকাছি একটা তেমাথায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
১১. প্রথম থেকেই মিটিং
১১.
প্রথম থেকেই মিটিং-এ বেড়াল কুকুরের ডাক আর টেবিল চাপড়ানি চলছিল। কর্মী বৈঠকে এরকম মাঝে মাঝে হয়ও। কিন্তু আজকের মিটিংয়ের টেম্পাে প্রথম থেকেই অ্যায়সা চড়েছিল যে, কারও কোনও কথা কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। দলের রাজ্য কমিটির সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, ট্রেজারার থেকে শুরু করে জনা দশ-বারো নেতা পার্টি অফিসের বড় ঘরের মেঝেয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে শতরঞ্চিতে অসহায়ভাবে বসা। তার মধ্যে মদনদাও। সবাই কথা বলার চেষ্টা করে হেদিয়ে পড়েছে। সেক্রেটারি বার তিন চার চেষ্টা করেছিলেন, একবার একটা গোল করে পাকানো সিগারেটের প্যাকেট এসে তার কপালে লাগল, সেই সঙ্গে চিকার, বসে পড়ো চাদু। সেক্রেটারি সেই যে বসে পড়েছেন আর ওঠেননি। ট্রেজারার একবার বাথরুমে যেতে চেয়েছিলেন, তিন-চারটে ষণ্ডা ছোকরা কাঁধ চেপে বসিয়ে দিল ওসব হবে না। গুরুপবাজির হিল্লে করে নাও আগে, তারপর হিসি টিসি।
জয় খুব ভিতরে সেঁধোতে পারেনি, দরজা দিয়ে ঢুকে প্রচণ্ড ভিড়ে দেয়ালে সেঁটে গেছে। পাশে হরি গোঁসাই, জয় ফিসফিস করে একবার বলল, বড় বড় নেতারা এভাবে হেকেল হচ্ছে, এ খুব অন্যায়।
হরি খিক করে হেসে বলে, চেপে যা। হচ্ছে হোক। একটু হওয়া দরকার।
মদনটা কোনও ইনিসিয়েটিভ নিচ্ছে না, দেখেছ?
চালাক লোক। পাবলিকের চোখে ইমেজ রাখছে।
কিন্তু মদনা দাঁড়ালে সব সমাধান হয়ে যাবে।
হলে এতক্ষণে মদনদা দাঁড়াত রে। তা নয়। কালকের ক্লোজডোর মিটিং-এ বসে নেতারা এককাট্টা হতে পারেনি।
বিমর্ষ মুখে জয় বলল, আজকাল নেতারা একদম এককাট্টা হতে পারছে না হরিদা। কী হবে বলো তো?
দল ভাঙবে। আবার কী? বাঁ কোণে নিত্য ঘঘাষ বসে আছে কেমন বেড়ালের মতো মুখ করে দেখছিস?
জয় একটা শ্বাস ফেলে বলল, দেখেছি। কিন্তু নিত্যদা আলাদা দল করতে চাইলেই কি হবে? নিত্যদার যে সেই ইয়েটা, কী যেন বলে, সেইটে নেই।
কিয়েটা?
ওই যে!–জয় সহজ ইংরিজি শব্দটা হাতড়াতে হাতড়াতে বলে, ওই যে ইনফ্লুয়েন্স না কী যেন!
তোর মাথা। এই মিটিং-এ বারো আনাই নিত্য ঘোষের লোক!
সে বুঝেছি। কিন্তু কী করে হয় বলো তো হরিদা। নিত্যদা তিনবার অ্যাসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে হেরে গেছে। ওকে কে পোঁছে?
সবাই কি ভোটে জেতে? জিতলেই যে তাকে সবাই পোঁছে এমনও নয়।
আমি বলছি হরিদা, একবার মদনদা যদি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে তা হলে
কী বোঝাবে?
এটা যে নিত্য ঘোষের চক্রান্ত সেই কথাটা।
বিপদ আছে রে।
কী বিপদ?
তখন নিত্য ঘোষও উঠে দাঁড়িয়ে মদনদার আর-একটা চক্রান্ত ফাঁস করে দেবে। ওরা কেউ কাউকে ঘাঁটাতে চাইছে না এখন। দল ভাগ হলে তখন কোমর বেঁধে লড়বে। এখন ক্যাডার কালেকশন।
মদনদার চক্রান্তের কথা নিত্য ঘোষ কী বলবে? মদনদার আবার চক্রান্ত কী? তুমি যে কী বলল হরিদা।
হরি গোঁসাই কী একটু বলার জন্য চুলবুল করেও সামলে গেল, বলার তো ট্যাকসসা লাগে না। পাবলিকের সামনে একটা কিছু টক ঝাল বললেই পাবলিক খেয়ে নেয়। আর পলিটিক্সওয়ালাদের কটা কথা সত্যি? চক্রান্ত না থাকে তো বানিয়ে একটা বলে দেবে।
লোকে বিশ্বাস করবে না।
চেঁচামেচি বাড়ছিল। আগের দিকে খুব একটা ঠেলাঠেলি চলেছে। একটা ছোকরা কী একটা বলছিল চেঁচিয়ে, তিন-চারজন তাকে ধরে খুব ঝাকাচ্ছে। ধাক্কা মেরে মেরে ভিড় ঠেলে বের করে আনছে। হরি গোঁসাই আর জয় দুজনেই ছোকরাকে চিনল। মদনদার বডিগার্ড শ্ৰীমন্ত।
জয় উত্তেজিত হয়ে বলে, স্টেট আর সেন্ট্রাল লিডারদের সামনে কী হচ্ছে দেখো হরিদা!
কিছু করার নেই। দেখে যা।বলে হরি গোঁসাই জয়ের হাতে একটু চাপ দেয়।
এরপর কি পার্টি মিটিং-এও পুলিশ ডাকতে হবে নাকি? প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকল না।
গলা উঁচুতে তুলিস না। লোকে তাকাচ্ছে।চাপা গলায় হরি গোঁসাই বলে।
মদনদা তবু কিছু করছে না, দেখেছ?
কী করবে? এতগুলো অ্যান্টি লোক।
সবাই অ্যান্টি? পার্টি ভাগ হলে মদনদা কোনদিকে থাকবে তা জানো?
হরি গোঁসাই ঠোঁট উলটে বলে, কে জানবে? নিত্য ঘোষ ডিসিডেন্ট, একটু জানি। দিল্লির একটা ফ্যাকশন নিত্য ঘোষকে অ্যাপ্রুভ্যালও দিয়েছে। যে গ্রুপ স্ট্রং হবে মদনা সেই দিকেই থাকবে মনে হয়।
জয় কথাটা শুনে খুশি হল না। একটু টেরিয়া হয়ে বলল, মদনদা কি সেই ধাঁচের লোক? যেদিকে আগুন দেখবে সেদিকেই হাত সেঁকবে?
দূর বোকা! উলটো বুঝেছিস। বলতে চেয়েছিলাম, মদনদা যেদিকে জয়েন করবে সেদিকটাই আলটিমেটলি স্ট্রং হবে। চল, বাইরে গিয়ে শ্রীমন্তকে ধরি। ব্যাপারটা একটু বোঝা যাবে।
জয়ের ইচ্ছে ছিল না। সে এই মিটিং-এর শেষটা দেখতে চায়। কিন্তু সামনের দিকে হুড়োহুড়ি বাড়ছে। ঠেলাঠেলি চলছে ভীষণ। দেখা যাচ্ছে না ভাল, তবে বোঝা যাচ্ছে সামনে আর-একটা মারপিট লেগেছে। মদনদার কিছু হবে না তো?
হরি গোঁসাইয়ের পিছু পিছু জয় বেরিয়ে আসে।
পার্টি অফিসের সামনে বারান্দা। বারান্দার নীচে একটু বাঁধানো জায়গা। কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। বিস্তর চেনা অচেনা আধচেনা পার্টি ওয়ার্কার দাঁড়িয়ে আছে।
শ্ৰীমন্ত ভিড় ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই একটা জিপ। একটা লোক জিপের সামনের সিটের ওপর একটা ভোলা ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলোয় কী একটা ওষুধ তুলে শ্ৰীমন্তর কবজিতে লাগাচ্ছে।