ঝিনুক উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনার বন্ধুর ফিরতে দেরি হবে। অফিস থেকে বেরিয়ে কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাবে খাবার আনতে।আপনি কি ততক্ষণ একা বসে থাকতে চান?
না।—বৈশম্পায়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, বরং একটু ঘুরে আসি।
কোথায় যাবেন?
বিশেষ কোথাও না।
ঝিনুক মৃদু একটু হাসে। বলে, তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
আমার বোন থাকে কাছেই, গোলপার্কের ওদিকটায়। ওর জন্য একটা ঝি ঠিক করেছি, বলে আসি।
বৈশম্পায়ন এত সৌভাগ্যের কল্পনা করেনি। একটু অবিশ্বাসী চোখে চেয়ে থেকে বলল, চলুন।
.
১০.
গড়িয়া স্টেশনের খানিকটা আগেই চলন্ত ইলেকট্রিক ট্রেনের কামরা থেকে একটা লোক লাইনের ধারে লাফিয়ে নামল। কাজটা খুব সহজ নয়। ইলেকট্রিক ট্রেনের কামরায় নামবার সিড়ি নেই, পাটাতনও বেশ উঁচু আর লাইনের ধারে অতি সংকীর্ণ জায়গায় নুড়ি পাথর ছড়ানো, যমদূতের মতো গা-ঘেঁষা লোহার পোস্ট। কিন্তু লোকটা নামল অনায়াসে, যেন প্রতিদিন এইভাবে নামা তার অভ্যাস। কামরার কিছু লোক তাকে বহুক্ষণ লক্ষ করছিল, এখন তারা মুখ বের করে তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে দেখছে। কেউ অবশ্য কিছু বলল না। তার চেহারাটাই এমন যে, লোকে কিছু বলতে সাহস পায় না, কাছে এগোতে চায় না।
ট্রেনটা এগিয়ে গিয়ে থামল। কয়েকশো গজ দূরেই স্টেশন। স্পষ্ট বিকেলের আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। বহু লোক। গিজগিজে ভিড়। সে এখন যতদূর সম্ভব ভিড় এড়াতে চায়।
নামবার সময় উপুড় হয়ে মাটিতে হাতের ভর দিয়েছিল সে। এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ঘষাঘষি করে ধুলো ময়লা ঝেড়ে ফেলল।
চারিদিকে শরতের ভারী সুন্দর এক বিকেল। বাঁয়ে গড়িয়ার বাজারে বোধহয় আজ হাট বসেছে। খালে একমাথা ভর ভরন্ত জল। আকাশে হেঁড়া হেঁড়া মেঘ। গাছপালা গভীর সবুজ। মেঠো গন্ধ। অবারিত মুক্ত মাঠঘাটে অগাধ বাতাস। গরম না, ঠান্ডাও না। লোকটা অবশ্য প্রকৃতির এই সাজগোজ লক্ষ করল না। তার সতর্ক তীক্ষ্ণ চোখ চারিদিকে ঝেটিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে নিচ্ছিল। যা দেখল তাতে নিশ্চিন্ত হল সে।অবশ্য এই নিশ্চিন্ত অবস্থাটা বেশিক্ষণের জন্য নয়। বহু চোখ তাকে খুঁজছে। খুঁজে পেলে যে আবার ধরে জেলে পুরবে, তা নাও হতে পারে। বেকায়দা দেখলেই গুলি চালাবে। তার অবস্থাটা খুব সুখের নয়। সুখে সে কোনওকালে ছিলও না। একটা রাতও নিশ্চিন্তে ঘুমোয়নি বড় হওয়ার পর থেকে। কোনও পথেই সাবধান না হয়ে হাঁটেনি কখনও। খুব ঘনিষ্ঠ লোককেও আগাপাশতলা বিশ্বাস করেনি।
ইশারা ছিল অনেক আগে থেকেই। দিন পনেরো আগে একজন পলিটিক্যাল আড়কাঠি জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করে যায়। বেশি ধানাই-পানাই করেনি, সোজা বলেছে, আমাদের হয়ে কাজ করবে?
সে বরাবরই এ দলের বা সে দলের হয়ে কাজ করেছে। সুতরাং এ প্রশ্নের জবাব দিতে ভাবতে হয়নি, করব।
ব্যস, কথা ওইটুকুই। কিন্তু তার মধ্যেই ইশারাটা ছিল। পরশু বিকেলে একজন কয়েদির মারাত্মক পেট ব্যথা। তাকে পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার ডাক পড়ল স্ট্রেচার ধরতে। হাসপাতাল পর্যন্ত রুগির সঙ্গে ছিল সে। বেড়ে তুলে দিল। আর তারপরই দেখল, পালানোর জন্য কসরতের দরকার নেই। শুধু ইচ্ছে। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সে পেচ্ছাপখানা হয়ে পিছনের সিড়ি দিয়ে নেমে গেল। কয়েদির পোশাকটাই ছিল সবচেয়ে বেখাপ্পা জিনিস, কিন্তু কলকাতার লোক আজকাল এতরকম বিচিত্র পোশাক পরে যে, লোকে তেমন মাথা ঘামায় না।
লোকটার বুদ্ধি তেমন বেশি নয়, লোটার মনে খুব একটা জটিলতা নেই, দুনিয়া সম্পর্কে তার ধারণা খুবই স্পষ্ট এবং মোটা দাগের। তার বেশির ভাগ অনুভূতিই শারীরিক। যেমন যৌনতা এবং ক্ষুধাবোধ। তবে শরীরের ব্যথা-বেদনার বোধ তার খুবই কম। তার মানসিক অনুভূতি এক আঙুলে গোনা যায়। কোনও ফালতু দুঃখ-টুঃখ আর তার নেই। শুধু আছে একটা প্রচণ্ড একরোখা আগুনে। রাগ, আছে ভয়ংকর রকমের টাকার লোভ, দুনিয়ায় প্রায় কারও প্রতিই তার কোনও গভীর ভালবাসা নেই, মানুষকে খুন করতে তার দুঃখ হয় না বটে, কিন্তু খুন করার পর সে বহুক্ষণ খুব অস্থির থাকে, তার একটা পশুসুলভ ভয়ও আছে, কিন্তু সেটা খুব কমই সে টের পায়। তবে একটা অনুভূতি তার প্রখর, সে আগে থেকেই বিপদের গন্ধ পায়।
পরশু রাতে কলকাতার ভিড়ে ছাড়া পেয়ে তার প্রথম জেগেছিল এক হিংস্র প্রচণ্ড কাম। সেই। তাড়নায় তার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আজকাল দুনিয়া খুব তাড়াতাড়ি পাল্টায়, দোস্তরা রং বদলে ফেলে, দল ভেঙে যায়। সে জেলখানায় থাকতে কী কী হয়ে গেছে তা না জানলে সে লাইনটা ধরতে পারবে না। লাইন ধরতে না পারলে বেরিয়েও লাভ নেই। খাবি খেয়ে মরতে হবে। তাই কোনও ঝুঁকি নেওয়া তার উচিত ছিল না। কিন্তু সেই কাম তাকে তাড়া করে আনল কসবা পর্যন্ত। নীতু বরাবর তার বাধ্য ছিল, বাঁধাও ছিল। সে নীলু হাজরার ফুকো খুনের মামলায় ঘানি টানতে যাওয়ার পর নীতু বিয়ে করেছে। বেশিদিন নয়, মাত্রই। নীতুকে নিয়ে মাঝে মাঝে থাকবে বলে সে রথতলার দিকে বস্তির যে ঘরটা ভাড়া নিয়ে রেখেছিল সেই ঘরেই সংসার পেতে বসেছে।
সেই সদ্য-পাতা সংসারে সে রাত ন’টায় হানা দিল।
কী রে নীতু! জমিয়ে নিয়েছিস?
যে নীতু তাকে দেখলে গলে পড়ত সে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। অদ্ভুত এক নাকিসুরে বলে উঠল, তুমি পালিয়েছ! আঁ!