বৈশম্পায়ন আবার লজ্জা পেয়ে বলে, তা হলে?
বাড়ি থেকে পালাচ্ছি আপনার বন্ধুর জন্য। কাউকে খেতে বললেই কি সঙ্গে একটা ককটেলেরও অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে? এত বিরক্তিকর। দেখবেন আয়োজনটা?
বলে ঝিনুক উঠে লিভিংরুমে চলে যায়। একটু বাদে দু হাতে গোটা চারেক বড় বোতল নিয়ে আসে। বলে, শুধু এতেই শেষ নয়। আরও ছ’টা বিয়ারের বোতলও আছে। ফ্রিজে সব ঠান্ডা হচ্ছে। কার না মাথা গরম হয় বলুন তো?
বৈশম্পায়ন স্কচ দেখে এবং বিয়ারের কথা শুনে শুকনো জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ঠিকই তো।
ঝিনুক ঝংকার দিয়ে বলে, আর ভাল মানুষ সাজতে হবে না। মদ দেখলেই আজকাল পুরুষগুলো এমন হ্যাংলামি করে। এতে আপনারা কী আনন্দ পান বলুন তো!
আনন্দ! ওঃ, না ঠিক আনন্দ নয় বটে।
ঝিনুক ভীষণ জোর ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, একটুও আনন্দ নেই। মদ খেয়ে ভুল বকে, আনবিকামিং বিহেভ করে, তারপর বমি আছে, হুল্লোড় আছে। কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো। তবু গুচ্ছের পয়সা খরচ করে সেই অস্বাভাবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চাই।
সেই জন্যই আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন?
ঝিনুক পুনমকে ডেকে বোতলগুলো আবার ফ্রিজে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, বোতলের গা থেকে মেঝেয় জল পড়েছে, মুছে নিয়ে যা তো!
ঘর মুছে পুনম চলে যাওয়ার পর ঝিনুক বলল, আমার কথার একটুও দাম দেয় না। এম পি বন্ধু এসেছে তো কী হয়েছে? তাই বলে বাড়িটাকে শুঁড়িখানা বানাতে হবে? আর আজকালকার এম পিরাই বা কীরকম? যখন তখন তারা মদ খাবে কেন?
মদের সপক্ষে কেউ বলার নেই দেখে বৈশম্পায়ন খানিক ভেবে এবং খানিক সাহস সঞ্চয় করে মৃদু করে বলল, ঠিক মদ খাওয়া নয়। স্টিমুল্যান্ট হিসেবে একটু খাওয়া খারাপ নয়। অনেক বড় বড় লিডারও খেতেন।
স্টিমুল্যান্ট! বলে ঝিনুক ব্যঙ্গের হাসি হাসল। বলল, তা হলে তো বলার কিছুই ছিল না। আমি আপনার বন্ধুকেও চিনি, মদনকেও চিনি। মদ পেলে এমন হামলে পড়বে যে, দেখলে মনে হয় এটা ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনও ইমপরট্যান্ট জিনিস নেই। হোটেল থেকে এক কাড়ি দামি খাবার নিয়ে আসবে, তার কিছুই শেষ পর্যন্ত খেতে পারবে না। বহুবার এরকম ঘটেছে।
তা হলে তো–বলে বৈশম্পায়ন সংশয় প্রকাশ করে।
সেই জন্যেই আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। মাতালদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না।
সব কথা যে বৈশম্পায়ন শুনতে পাচ্ছে বা বুঝতে পারছে তা নয়। সে চেয়ে আছে, বুঝবার চেষ্টাও করছে, কিন্তু ঝিনুকের সৌন্দর্য থেকে একটা সম্মােহন ওর গায়ের সুগন্ধের মতোই বার বার উড়ে এসে আচ্ছন্ন করছে তাকে। ঝিনুক! কী সুন্দর!
বৈশম্পায়ন সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুজে রেখে বলল, আপনি যদি বেরিয়ে যান তা হলে আমারও খালি বাড়িতে বসে থাকার মানে হয় না।
এই বলে বৈশম্পায়ন উঠতে যাচ্ছিল, ঝিনুক ভারী নরম মায়াবী গলায় বলল, আপনি তো ওদের মতো একন্ট্রোভারট নন, তবে আপনি খান কেন বলুন তো! যারা সিরিয়াস মানুষ, যাদের মনের গভীরতা আছে তারা কেন এসব বাজে ফুর্তি করবে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না।
বৈশম্পায়ন অপরাধী মুখ করে লাজুক গলায় বলে, আমার মনে কোনও নেশা নেই, তবে প্রেজুডিসও নেই।
নেশা মাধবেরও নেই। কিন্তু কোনও অকেশন পেলেই মদের চৌবাচ্চায় লাফিয়ে পড়বে। আজকাল লোকে এত মদ খায় কেন তা আমি একদম বুঝতে পারি না।
বৈশম্পায়ন সম্মােহনের আর একটা ঘোর কাটাল।ঝিনুক! কী সুন্দর!
মৃত্যুনদীর কলরোল কানে ভেসে আসছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে আয়ু। জীবনে সময় বড় কম। বড় কম। তুমি কি জাননা, ঝিনুক, কিশোরী বয়স থেকে আমি তোমার প্রেমিক।
বৈশম্পায়ন যে হাসিটা হাসল তা সম্মােহিতের হাসি। বলল, কেন যে খায় তা আমিও জানি না। মদের দামও আজকাল ভীষণ, তবু তো খাচ্ছে।
ঝিনুক ভ্রু কুঁচকে বলল, মদের দাম কি খুবই বেশি?
খুব বেশি। প্রতি বছর বাজেটে ট্যাকস বসে আর দাম ওঠে।
ওই বোতলগুলোর দাম কত হবে জানেন?
মাথা নেড়ে বৈশম্পায়ন বলে, আমার ঠিক আইডিয়া নেই। তবে পঞ্চাশ-ষাট টাকা বা তারও বেশি।
চোখ কপালে তুলে ঝিনুক বলে, একেকটা বোতলের অত দাম?
খুব কম করে ধরেও।
ইসস। বলে ঝিনুক তার চমৎকার হাতখানা হোট কপালে রেখে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
মদ খুবই একসপেনসিভ নেশা। বৈশম্পায়ন মৃদুস্বরে বলে, আপনি কি জানতেন না?
ঝিনুক কুটি করে বৈশম্পায়নের দিকে চেয়ে বলে, আমার মদের দাম জানার কথা নাকি?
বৈশম্পায়ন ঢোক গিলে বলে, ঠিক তা মিন করিনি। তবে আজকাল সবাই সব খবর রাখে।
ঝিনুক বিরক্ত গলায় বলে, আমি সকলের মতো নই।
বৈশম্পায়নের ভিতর থেকে কে যেন সঙ্গে সঙ্গে পো ধরে, তা ঠিক। আপনি অন্যরকম।
ঝিনুক আবার ভ্রুকুটি করতে গিয়ে হেসে ফেলে বলে, আমি কীরকম বলুন তো?
বৈশম্পায়নের ঠোঁটের কথা ঠোঁটেই মরে যায়। আর একটা সম্মােহনের ঢেউ এসে আচ্ছন্ন করে তাকে। ঝিনুক! কী সুন্দর! তুমি যেখান দিয়ে হেঁটে যাও সেই পথে সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে থাকে। যেদিকে তাকাও, আলো হয়ে যায়। তোমার জন্যই সেতু বন্ধন। তোমার জন্যই ট্রয়ের যুদ্ধ। তোমার জন্যই বেঁচে থাকা মরে যাওয়া। তুমি কীরকম তা কি বলে শেষ করা যায়? কথার অত ক্ষমতা নেই ঝিনুক।
ঝিনুক এই অসহায় লোকটিকে রেহাই দিয়ে একটা খাস ফেলে বলল, আমি ভীষণ খারাপ, জানি।
না, না।-বৈশম্পায়ন প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।