গৌরী মাথা নেড়ে বলে, পুকুরে হাত-পা ধুতে গেছে। এক্ষুনি আসবে।
মদন বলে, হ্যাঁ, আমরা তিনজনই তোমাকে পছন্দ করতাম। তাই না?
নীলুর কথা থাক। তবে আপনারা দু’জন করতেন। মানছি।
কিন্তু তুমি নবকেই দেহ-মন দিয়েছিলে, আমাদের পাত্তা দাওনি।
নবকে আমি মন দিইনি।খুব ক্ষীণ গলায় গৌরী বলল।
শুধু দেহ?
সেটাও ও জোর করে নিত।
আর মনটা? সেটা কাকে দিয়েছিলে? আমাকে, না নীলুকে?
তা জেনে কী হবে? আপনি তো আগে কখনও জানতে চাননি।
তা ঠিক। তবে জানতে চাইতে হবে কেন বলো তো। মন দিলে তো এমনিতেও টের পাওয়ার কথা।
বহু মেয়েই আপনাকে মন দিয়েছিল, তাদের দিকে তাকানোর সময় আপনার ছিল না।
সময় ছিল না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে টেরও পেতাম না ভেবেছ? শুধু তোমারটাই টের পাইনি। কোনওদিন। তবে নীলু টের পেত কি না জানি না।
কান্নার আগে যেমন মুখ হয়, গৌরীর মুখ এমন ঠিক সেইরকম। চোখ স্থির, লাল, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবেগটাকে ঠেকাচ্ছে। পাখাটা রেখে ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময় দবজায় নবর মা উঠে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে আবছায়াতেও বুড়ির নজর মদনকে চিনে ফেলেছে। চোখে ভারী অবাক ভাব। মুখখানা হা করা।
মদন মৃদু একটু হেসে বলে, এই যে মাসি! আপনার বউমার চাকরির একটা খবর আছে। তাই দিতে এলাম।
নিজে এলে! কী ভাগ্যি! আমি ভাবছিলাম, বড় মানুষ, বোধহয় গরিবের কথা ভুলেই গেছ।
বুড়ির গলাটা টনটনে। স্বাভাবিক স্বরটাও সাতবাড়িতে শোনা যায়।
মদন বলল, নব আমার সাকরেদ ছিল। তার জন্য এটুকু করা কিছু না।
তা ঠিক।–নবর মা একগাল হেসে বলে, তা কাল থেকেই কি যাবে বউমা?
মদন মাথা নেড়ে বলে, না মাসি। চাকরি এখানে নয়, দিল্লিতে।
দিল্লি? ও বাবা, তা হলে এখানে কী হবে?
এখানে আপনি তো রইলেন।
বুড়ি গলাজলে আঁকুপাকু খেতে থাকে। কথা ফোটে না মুখে। এই সময়ে বুড়ির পাশ কাটিয়ে গৌরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মদন চোখ টিপে বলে, চাকরি তো এখানেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নবর বউ করতে চাইছে না। বলে, নবব কারখানায় চাকরি করতে নাকি ঘেন্না করে।
বলল?–বুড়ির গলা সাত বাড়ি ছেড়ে সাতটা গাঁয়ে পৌছে যায়।
মদন উঠে পড়ে। ভাগীরথীর মুখ খুলে গেছে। এবার খেউড়ের বেনোজল নেমে আসবে। খুব ইচ্ছে ছিল মদনের, বসে থেকে শুনে যায়। কিন্তু ঘড়ি ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। বাইটার্সে মিটিং। বিকেলে পার্টির জরুরি সভা।
মদন দাঁড়িয়ে বলল, আমি দিল্লি গিয়েই ব্যবস্থা করছি। নবর বউ যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়। সম্ভব হলে আজই।
গিয়ে কোথায় উঠবে?
সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চলি।
বলে মদন বেরিয়ে আসে। রাস্তায় পড়ে কয়েক কদম গিয়ে একটু দাঁড়ায়। ওই শোনা যাচ্ছে সারা এলাকা মাত করে নবর মায়ের গলা চৌদুনে পৌছল, গেছো মাগি… অমুকভাতারি… তমুকভাতারি ..
মদন আর দাঁড়াল না। মৃদু একটু হেসে হাঁটতে লাগল। লাগ ভেলকি লাগ! নারদ নারদ!
.
০৯.
সময়ের একটু আগেই পৌছে গেল বৈশম্পায়ন। ভারী লজ্জা লজ্জা করছিল তার। রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন, কিন্তু এখনও ভাল করে দিনের আলোটাও মরেনি।
কিন্তু না পৌছে উপায়ই বা কী? কাল থেকে ঘরে শুয়ে শুয়ে শরীরে জড়তা এসে গেছে। আর মনটা পাগল-পাগল করছে কেয়াতলার এই বাড়িটার কথা ভেবে। উদ্দাম এক হাওয়া এসে পালে লাগছে বার বার। বন্দর ছাড়তে বলছে। ভেসে পড়ো। ভেসে পড়ো। সামনে অকুল দরিয়া। মৃত্যুশাসিত এই পৃথিবীতে মানুষের সময় বড় কম। লাভালাভ, ভোগ-উপভোগ সব সেরে নাও বেলাবেলি।
আজও দরজা খুলল কিশোরী ঝি পুনম। বাইরের ঘর আজ আরও পরিপাটি সাজানো। চন্দনের গন্ধওয়ালা ধূপকাঠি জ্বলছে। অন্তত চার ডজন রজনীগন্ধা। ঘরে কেউ নেই।
ইতস্তত করে বৈশম্পায়ন জিজ্ঞেস করে, মাধব আসেনি?
না, মামাবাবুর তো অফিস।
এ কথায় আরও লজ্জা পায় বৈশম্পায়ন।
বড্ড বেশি আগে আগে চলে এসেছে। এখন কিছু করার নেই। সে সোফার এক কোণে বসে সিগারেট ধরাল। ভিতরে ভিতরে একটা কামনা শেয়ালের মতো ছোঁক ছোঁক করছে, উঁকি মারছে এদিক-সেদিক।
কিন্তু এই নিরিবিলি ঘরটিতে বসে, ঠুলি পরানো আলোয় কিছুক্ষণ চারদিকের ভৌতিককে অনুভব করতে করতেই দূর, বহু দুর থেকে মৃত্যুদীর করুণ গান ভেসে এল। সাদা পাথর, বিশাল উপত্যকা, অন্তহীন নদী, অবিরল তার গান।
জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল আঙুল থেকে। নিচু হয়ে তুলবার সময় সে দুর্দান্ত সুগন্ধটা পেল বাতাসে। এইসব সুবাস মাখে একজন। মাত্র একজনই। সে ঘরে এসেছে নিঃশব্দে। সিগারেটটা কুড়োতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিল বৈশম্পায়ন।
সামনে সোফায় ততক্ষণে মুখোমুখি স্থির হয়ে বসেছে ঝিনুক।
বৈশম্পায়ন মুখ তুলে বলল, কী খবর?
ঝিনুকের পরনে বেরোনোর পোশাক। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, পায়ে চটি, চোখে ভ্রুকুটি।
ঝিনুক মৃদু কিন্তু রাগের গলায় বলে, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি।
বৈশম্পায়ন একটু অবাক হয়ে বলে, সে কী? কেন?
কেন তা আপনাদের বোঝা উচিত।
বৈশম্পায়ন ঝিনুকের অসহনীয় সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে মনে মনে ভীষণ হতাশা বোধ করে। এত রূপ যার সে কি কখনও সহজলভ্য হতে পারে? বড় দূর, বড় দুর্লভ ঝিনুক।
সে বলল, আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার জন্যেই নাকি?
আপনার জন্য! ও মা, কী কথা বলে লোকটা! আপনার জন্য বাড়ি থেকে পালাব কেন?