শ্ৰীমন্ত অবাক হয়ে বলল, একা যাবে?
একাই যেতে হবে।
তোমার কাছে আর্মস নেই!
তাতে কী? আমি কোনওকালে আর্মস নিয়ে চলি না। ভয় নেই, আর্মস ছাড়াও আমার অন্য কিছু আছে সেটা তুই বুঝবি না।
কাজটা ঠিক করছ না মদনদা। নব এখন ফ্রি ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাড়িতে একবার ঢুঁ দেবেই।
দুর বোকা!নব তোর চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। ও জানে,পুলিশ ওর বাড়ির চারদিকে জাল পেতে আছে।
তা অবশ্য ঠিক।
শ্ৰীমন্ত মাথা চুলকায়। একটু কেমন লাগে শ্ৰীমন্তর। মদনদা তাকে সঙ্গে নিচ্ছে না। মদনদা গম্ভীর। কোথাও একটা তাল কেটে যাচ্ছে।
ভয় নেই।বলে মদন একটা ভাঙাচোরা মেটে রাস্তা ধরে এগোতে থাকে।
এদিকে অনেক নিবিড় গাছপালা, পুকুর, কঁকা জমি। একেবারেই হদ্দ গ্রাম। বেশির ভাগ নিম্নমধ্যবিত্তদের বাস বলে বাড়িঘরগুলোর তেমন বাহায় নেই। ম্যাড়ম্যাড়ে, শ্রীহীন। মদনের খুব খারাপ লাগছিল না। সে একবার ঘুড়ি দেখল। প্রায় এগারোটা। বেলা একটায় রাইটাসে মিটিং। সময় আছে। তবু সে একটু পা চালিয়ে হাঁটে।
আধ মাইলের মতো হেঁটে একটা শ্রীহীন, ভারী গরিব চেহারার চালাঘরের সামনে উঠোনে পা দেয় মদন। নব টাকা কামাই করেছিল মন্দ নয়, কিন্তু ঘর-সংসারের পিছনে কিছুই ঢালেনি। কেবল অন্য সব ফুর্তিতে উড়িয়ে দিয়েছে। এই কাঠা তিনেক জমিও ওকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি। ঝোপজঙ্গলে ভরা এই তিন কাঠা এক মুসলমানকে ভোগা দিয়ে দখল করেছিল সে। সেই জমি আর চালাঘরটাই এখন নবর আত্মীয়দের একমাত্র আশ্রয়।
মদন উঠোনে পা দিয়ে একবার ফিরে চাইল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা ঘাড়েগদানে চেহারার লোক তাকে দেখছে। গায়ে হাফ-হাতা নীল রঙা একটা শার্ট, পরনে ময়লা ধুতি। সাদা পোশাকের পুলিশকে চিনতে এক লহমাও লাগে না মদনের। সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। তারপর অনুচ্চ স্বরে ডাকে, গৌরী! গৌরী!
এত ভদ্র গলায় বোধহয় বহুকাল কেউ গৌরীকে ডাকেনি। খোলা দরজায় গৌরী এসে অবাক চোখে তাকায়।
গৌরী ফরসা নয়। তবে ভারী মিঠে মোলায়েম একটা শ্যামলা রং ছিল তার। ছিল অফুরন্ত স্বাস্থ্যের শরীর। ছিল অকূল দু’খানা চোখ। মুখে উপচে পড়ত শ্ৰী।
এখন তার কিছুই প্রায় নেই। শরীর শুকিয়ে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। রং কালো হয়ে গেছে। এখনও শুধু চোখ দুখানা আছে। তাকালে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আজও।
আমি মদনদা। চিনতে পারছ?
গৌরীর শুকনো হাড্ডিসার মুখে একটু হাসি ফুটল। খুব অবিশ্বাসের হাসি। প্রথমটায় বুঝি কথা সরল না। তারপর মৃদু লাজুক স্বরে বলল, এলেন তা হলে! আসুন।
বেশিক্ষণ বসার সময় নেই।
গৗরী হারিয়ে গিয়েছিল, এই কথায় হঠাৎ যেন ঝলসে উঠল পুরনো গৌরী। বলল, একটু বসে না গেলে লোককে কী করে বিশ্বাস করাব যে, একজন এম পি আমাদের বাড়িতে এসেছিল?
মদন মৃদু হেসে নামমাত্র দাওয়ায় উঠে চটি ছেড়ে রাখে। বলে, ঘরে নয়। এইখানেই একটা মাদুর-টাদুর পেতে দাও।
গৌরী বলে, না। এখানে আব্লু নেই। ঘরে আসুন। গরম লাগবে একটু, তা আমি পাখার বাতাস দেব’খন।
অগত্যা মদন ঘরে ঢোকে। যেমনটি আশা করা যায়, ঘরটি ঠিক তেমনিই। বেড়ার গায়ে গুটি তিনেক ছোট জানলা বসান। রোদে তাতা টিনের গরমে ভেপসে আছে ভিতরটা। দু ধারে দুটো সস্তা চৌকিতে অত্যন্ত নোংরা বিছানা। কয়েকটা ফুটপাথে কেনা র্যাকে রাজ্যের কৌটো-টোটো রাখা। তবে একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়ো আছে, লক্ষ করে মদন।
তোমার শাশুড়ি কই?
উনি একটা বিড়ির কারখানায় যান।
ছেলেমেয়ে?
গৌরী একটা শ্বাস ফেলে বলে, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে।
লেখাপড়া করে না?
নাম লেখানো আছে ইস্কুলে। যায় বলে তো মনে হয় না।
দু’জন। বড়টা ছেলে। ছোটটা মেয়ে। তোমার কটি?
গৌরীর হাতপাখাটা নড়বড়ে। মচাৎ মচাৎ শব্দ হচ্ছে। মদন বলল, থাক গে। পাখা রেখে দাও।
গৌরী রাখল না। বলল, কেমন আছেন?
ভাল নেই গৌরী।
আপনি ভাল নেই? তবে আমরা কোথায় যাব!
তোমার শাশুড়ি গতকাল আমার কাছে গিয়েছিল।
জানি। আমি বারণ করেছিলাম, শোনেনি।
বারণ করেছিলে কেন?
গৌরী একটু উদাস হয়ে বলে, কী হবে গিয়ে? আমার জীবনে তো আর ভাল কিছু হবে না।
মদন একটু চুপ করে থেকে বলে, তোমার চাকরিটা হয়ে গেছে।
কোথায়?
নবর কারখানায়।
খবরটা শুনে গৌরী গা করল না। বলল, ও।
কারখানায় ওদের অফিসও আছে। সেই অফিসে।
গৌরী জবাব দিল না। হাতপাখার মচাৎ মচাৎ শব্দ হতে লাগল।
মদন একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, নবর কারখানায় কি তুমি চাকরি করতে চাও না?
গৌরী মৃদু স্বরে বলল, এই প্রশ্নটাই আপনার আগে করা উচিত ছিল মদনদা।
মদন বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, কাল তোমার শাশুড়ি গিয়ে নবর কারখানায় তোমাকে একটা চাকরি দেওয়ার কথা বলল, তখনও ভেবে দেখিনি যে, তোমার কাছে চাকরিটা কতখানি অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে।
গৌরী একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক আপনার বুদ্ধি এখনও লোপ পায়নি দেখছি। একটু দেরিতে হলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।
মদন মাথা নেড়ে বলে, বুদ্ধির ধার কমেও যাচ্ছে। আগের চেয়ে মাথা এখন অনেক কম। খেলে।
গৌরী একটু ক্লান্ত স্বরে বলল, নবর মাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে,ওর কারখানায় আমার কাজ করা বিপজ্জনক। ওর শত্রু অনেক। তার ওপর ওর উল্টো ইউনিয়ন এখন কারখানা দখল করেছে। ওখানে চাকরি করা কি সম্ভব! কিন্তু নবর মা তা মানতে চায় না।