আহা, কখন কী দরকার হয় তার কি ঠিক আছে? তবে পয়সা দিয়ে করতে একটু গায়ে লাগে আজকাল। ফোনের চার্জ যা বেড়েছে।
কেন, অফিস থেকে করবেন!
মণীশ ম্লান একটু হাসে, অফিস থেকে। অফিস থেকে প্রাইভেট ফোন করতে একটু কিন্তু কিন্তু লাগে।
মদন মাথা নেড়ে মাধবকে বলে, জামাইবাবু একটা হোপলেস কেস, বুঝলি মাধব? হি ইজ হেলপলেসলি অনেস্ট। এ রোগের চিকিৎসা নেই।
মাধব হা করে একটু চেয়ে থেকে বলল, জামাইবাবুর অনেস্টি সম্পর্কে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা যে শুচিবায়ু হয়ে দাঁড়াচ্ছে!
মণীশ খুব দুর্বলভাবে একটু হাসে।
.
০৮.
তুই ভয় পেয়েছিস?—মদন জিজ্ঞেস করে।
শ্ৰীমন্তর মুখ করুণ গম্ভীর। কোনও বিপদ বা ঝামেলা পাকালে শ্ৰীমন্তর মুখ ওইরকম হয়ে যায়। তাকাতে ভয় করে। সে মদনের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বলে, না। তবে কেয়ারফুল থাকা ভাল।
মদন আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল। বলল, তা থাক। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
শ্ৰীমন্ত মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে বোধহয় মদনকে একটা খিস্তি দিল। তার কারণ নব জেল থেকে বেরিয়েও মদনের নাগাল পাবে না। তার আগেই চিড়িয়া ভেগে যাবে দিল্লি। তারপর বিদেশে। কলকাতার ঘুণচক্করে নবর পাল্লা টানতে পড়ে থাকবে শ্ৰীমন্ত আর তার সাকরেদরা। কাজটা খুব সহজ নয়। যারা নবকে চেনে তারাই জানে।
কথা হচ্ছিল একটা অ্যামবাসাড়ার গাড়িতে বসে। সকালবেলা। গাড়ি যাদবপুর পেরিয়ে বাঘাযতীনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই বোড়াল।
দিল্লিতে আমার জন্য একটা চেষ্টা করবে বলেছিলে মদনদা।
হবে।–মদন অন্যমনস্ক ভাবে বলে, এখানেও তো বেশ আছিস!
একে থাকা বললা! ভদ্রলোকের মতো থাকতে গেলে কলকাতায় কিছু হবে না। দিল্লিতে একটা ব্যবস্থা করে দাও।
কী করবি?
যা হোক। একটা দোকান, না হয় বাস বা ট্যাক্সির পারমিট।
ওখানে পারবি না। শক্ত কাজ। তবু যদি যেতে চাস তো চেষ্টা করব।
করো।
তুই একটু ভয় খেয়েছিস শ্ৰীমন্ত।
শ্ৰীমন্ত জানে, মদনদা এই যে দিল্লি যাবে, গিয়েই ভুলে মেরে দেবে তার কথা। ভি আই পি-রা সব একরকম। মদনের ওপর নানা কারণেই একটু চটে আছে সো লোকটা কথা দিয়ে কথা রাখে না। তার ওপর ভয়ের খোঁটা দেওয়া হচ্ছে। শ্ৰীমন্ত ঠান্ডা গলাতেই পালটি দিল, ভয় একটু তুমিও খেয়েছ মদনদা। নইলে এই সাতসকালে জরুরি কাজ ফেলে বোড়াল রওনা হতে না।
মদন হাসে। একটু অপ্রতিভ বোধ করে না। বলে, কাল নবর মাকে কথা দিয়েছিলাম। কানোয়ারকে সকালে ফোন করতেই রাজি হয়ে গেল। খবরটা দিয়ে আসা কি খারাপ?
খারাপ বলছি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, নবর মাকে তুমি কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ওকথা বলেছ।
মদন একটু চুপ করে থেকে বলে, শত হলেও এক সময়ে নব আমার জন্য অনেক করেছে।
শ্ৰীমন্ত কথা বাড়াল না। কিছুদিন যাবৎ মদনদার সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছে না এটা সে নিজেই টের পাচ্ছে। মদনদাও কি আর টের পাচ্ছে না?
মদন একটা সিনেমা হলের হোর্ডিং দেখল ঘাড় ঘুরিয়ে। মুখ ফিরিয়ে বলল, এ কথাটা যেন চাপা থাকে।
নবর বউয়ের চাকরি তো? ও নিয়ে ভেবো না।
দিল্লি সত্যিই যেতে চাস?
চাই। কলকাতায় কী হবে বলল। হুজ্জতি করা আমার রক্তে নেই। ওসব মেলা হয়েছে। এইবার সেটল করতে চাই।
তুই বি কম পাশ না?
টুকে মুকে। ওসব বিদ্যে ধোররা না। ধ্যাড়াব!
না, তোকে দিয়ে চাকরি হবে না সে আমি জানি!
চাকরিটাও রক্তে নেই কিনা। আমার বাপ পুরুত ছিল। মেলা যজমান। আমিও নাকি অনেকের কুলগুরু। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে বেশ বুড়ো বয়স্ক মানুষও দুম করে পেন্নাম ঠুকে দেয়। কতক বাড়ি আছে যেখানে গেলে আমার জামাই আদর।
মদন হাসে, লাইনটা তো ভালই।
হ্যাঁ, ভাল না হলে আমার বাবা চিরকাল ও কাজ করবে কেন? চাকরি আমাদের বংশে কম লোকই করেছে।
নিষ্ঠাবান বামুনের ছেলে হয়ে তুই খুনখারাপি করিস কী করে?
মাইরি মদনদা, ঠুকো না। খুনখারাপি আমার সয় না। একটু হাঁকডাকের লোক ছিলাম বটে বরাবর। কিন্তু এতটা হয়ে যাব ভাবিনি।
মদন শ্ৰীমন্তর হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলল, তুই একটু নরম আছিস।
আছি মদনদা। স্বীকার করছি।
নবর মতো তুই কেঠো মানুষ নোস।
তাও নই।
নবর সঙ্গে যদি পাল্লা টানতে হয়, পারবি?
শ্ৰীমন্ত একগাল হাসে, পারব। তাতে আটকাবে না। তবে আমি ওর মতো নীচে নামতে পারি না। তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ তো?
পারছি। আমার লোক নিয়েই কারবার। তোর মুশকিল হল, তুই যে ভদ্রলোক তা ভুলতে পারিস না। আর, কিছু লোক যে তোকে দেখলে প্রণাম করে সেটাও ততাকে কাছা ধরে টানে মাঝে মাঝে।
শ্ৰীমন্ত হাসল। বলল, সবই তো বোঝো দাদা।
আমি তোরটা বুঝি। কিন্তু তুই আমারটা বুঝিস না।
কেন বলছ ওকথা?
এই যে বললি, ভয় পেয়েছি বলেই নাকি আমি নবর বউয়ের চাকরি করে দিচ্ছি।
ওটা একটা ফালতু কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
মদন চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে শ্ৰীমন্তরও বুকটা একটু গুড় গুড় করে ওঠে। তার গায়ে জোর আছে, পকেটে লোডেড রিভলভার আছে, সাহসও আছে, তবু সে জানে মদনদার মতো লোক তার মতো হাজারজনাকে নাচিয়ে বেড়াতে পারে। বে-খেয়ালে বেচাল বলে ফেলেছে।
শ্ৰীমন্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, মদনদা, রেগে আছ মাইরি?
মদন জবাব দিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
বোড়ালে বড় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মদন নামল। শ্ৰীমন্ত নামতে যাচ্ছিল, মদন হাত তুলে বলে, না। তুই থাক।