মদনের মুখে কথা ফুটল না। কিন্তু চাপা নিষ্ঠুরতাটা জ্বলজ্বল করতে লাগল। মাধব জানে, মদনের মধ্যে একটা কিছু আছে। কিন্তু সেটা কী তা এত বছরেও বুঝতে পারল না। ছেলেবেলায় আসানসোলে কলিয়ারির এলাকায় তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। লোকে বলত, মদনমাধব। এত গলাগলি ছিল, তবু মদনের মধ্যে প্রকৃতিদত্ত একস্ট্রা ফাউ জিনিসটার জোরেই না ব্যাটা এম পি। আর সেই ফাউ জিনিসটা যা মাধবের নেই, সেটা এখন মদনের মুখে চোখে ঢেউ দিচ্ছে।
মাধব তার খড়খড়ে দাড়িওলা গাল চুলকোল। তারপর একটু মিয়োনো গলায় বলল, তুই কলকাতায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নব জেল ভেঙে পালাল, এর মধ্যে একটু অদ্ভুত যোগাযোগআছে না? ব্যাপারটা ভেবে দেখেছিস?
মদন মাথা নাড়ে, না। অত ভাববার সময় নেই। ভেবে লাভও নেই। গোটা দুই মুরগা কিনে নিয়ে বাড়ি যা। ঝিনুককে ভাল করে রাঁধতে বলিস।
ঝিনুক গত বছর পাঁচেক রান্নাবান্না করেনি।
বলিস কী?
ঝিনুক না রাঁধলেও আমরা না খেয়ে থাকি না। রান্নার লোক আছে, চিন্তা নেই।
তবে মুরগা কিনে বাড়ি যা। একটু বেশি করে বান্না করতে বলিস। আমি তোদের না জানিয়েই। বৈশম্পায়নকেও নেমন্তন্ন করে দিয়েছি।
বৈশম্পায়ন! বলে একটু হাসে মাধব, কিন্তু কোনও মন্তব্য করে না।
মদন অবশ্য তীক্ষ্ণ চোখে হাসিটা দেখল। বলল, হাসলি কেন? এনিথিং রং?
না, নাথিং রং!
ওকে নেমন্তন্ন করায় তোরা অসুবিধেয় পড়বি না তো!
মাধব মাথা নেড়ে বলে, অসুবিধে তো তোকে নিয়ে! ঝিনুক বলে দিয়েছে ড্রিংক করলে বাড়ি থাকবে না।
হোঃ হোঃ করে হাসে মদন। তারপর গলা নামিয়ে বলে, ড্রিংকস কি বাদ যাচ্ছে নাকি?
না। তবে ছোট করে হবে।
ঝিনুক বাড়ি থাকবে?
মাধব এবার খুব অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি হেসে বলে, বোধহয় থাকবে। বৈশম্পায়ন আসছে জানলে থাকবেই মনে হয়।
তীক্ষ্ণধার চোখে মাধবের মুখটা দেখে নিচ্ছিল মদন। ঝুঁকে আস্তে করে বলল, ইজ দেয়ার এনি অ্যাফেয়ার?
সিরিয়াস কিছু নয়। দু’জনেই দুজনের প্রতি একটু সফট। ব্যাপারটা আমি খুব এনজয় করি।
মদন হতাশার গলায় বলে, তোরা একেবারে হোপললস। বউ অন্যের সঙ্গে প্রেম করলেও সেটা তোরা এনজয় করিস কী করে?
আস্তে মদনা, আস্তে।—মাধব গলা আর-এক পরদা নামিয়ে বলে, দুনিয়াটাই তো রঙ্গশালা। কে কার বউ? কে কার প্রেমিকা? আমি পজেসিভ নেচারের লোক নই। আমি শুধু দেখি, শেষযৌবনা এক মহিলা মধ্যবয়স্ক একজনের প্রেমে পড়ে কেমন বয়ঃসন্ধির ছুকরি হয়ে যাচ্ছে। ঘ্যাম নাটক মাইরি।
সেই নাটকে তোর ভূমিকা কী? পরদা টানা?
না। আমার ভূমিকা ছিল ভিলেনের। কিন্তু আমি মাইরি ফিলজফার হয়ে গেছি। তবে রেফারির মতো নজরও রাখছি। বাড়াবাড়ি দেখলেই ফাউল বা অফসাইড বলে চেঁচিয়ে বাঁশি বাজাব।
এই সময়ে শোওয়ার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে চিরু আসে। মাধবের দিকে চেয়ে বলে, বন্ধু এসেছে বলে তোর টিকি দেখা গেল। নইলে দিদি মরল কি বাঁচল সে খবরও তো নিস না।
মাধব এক গাল হেসে বলে, তোমার মরার কী? দিব্যি গায়ে-গতরে হয়েছ।
মোটা হয়েছি বলছিস?
মোটা নয়, মোটা নয়। পরিপূর্ণ হয়েছ।
ফাজিল। চা খাবি?
মদন একটু ধমক দিয়ে বলে, আরে তুই দুনিয়াসুদ্ধ লোককে চা খাওয়াতে গিয়ে যে পতিদেবতাটিকে ভাত খাইয়ে অফিসে পাঠাতে পারবি না।
না। না খেয়ে যাবে না, ডাল ভাত নেমে গেছে। সেই ভোর রাতে তুই যখন বেরলি তখনই উঠে সব সেরে ফেলেছি।
মাধব একটা শ্বাস ফেলে বলে, তা হলে চিরুদি, গরিব ভাইকে একটু চা খাওয়াও।
তুই গরিব? কেয়াতলায় ফ্ল্যাট কিনেছিস, তুই যদি গরিব তো আমরা কী?
তোমরা সবাই শুধু আমার ফ্ল্যাটটাই দেখলে! আর আমি যে দিনকে-দিন শুকিয়ে যাচ্ছি।
তুই আবার শুকোলি কোথায়?—চিরু অবাক হয়ে বলে, বেশ তো চেহারাটা দেখাচ্ছে। একটু এলোমেলো অবশ্য। রাতে ঘুমোসনি নাকি?
না, সেসব নয়। মাঞ্জা দেওয়ার সময় পাইনি।
ঝিনুক কেমন? বেশি মোটা হয়ে যায়নি তো?
না, না। রেগুলার যোগাসন করে, কম খায়, সারাদিন শরীরের যত্ন করে, কাজকর্ম নেই, মোটা হবে কেন? ভাল আছে।
বউয়ের কথা উঠলেই তোরা অমন বেঁকিয়ে কথা বলিস কেন বল তো? বউগুলো কি মানুষ নয় নাকি?
বেঁকিয়ে বললাম কোথায়?—মাধব অবাক হওয়ার ভান করে।
ওই যে বললি, সারাদিন শরীরের যত্ন করে, কাজ করে না, আরও সব কী যেন।
তোমার মনটাই বাঁকা। একজন মহিলা নিজের শরীরের যত্ন নেয় এটা তো প্রশংসার কথাই। তুমি যে নাও না, তার জন্য আড়ালে আমরা তোমার নিন্দে করি।
চিরু হেসে ফেলে বলে, ইয়ারবাজ। বোস, চা করি আনি।
হ্যাঁ, যাও। রান্নাঘর ছাড়া তোমাকে কোথাও মানায় না।
সেটা তোর জামাইবাবুও খুব ভাল বুঝেছে।
এতক্ষণ মদন একটাও কথা বলেনি। কোনও কথা তার কানেও যায়নি। নিজের নখগুলোর দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবছিল।
মণীশ বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, যাও ব্রাদার, খবরের কাগজ নিয়ে আধবেলার জন্য ঢুকে পড়ো।
কোঁচকানো সটান হল, একটু হেসে মদন বলে, অত সময় যদি হাতে থাকত জামাইবাবু। এক্ষুনি রাইটার্সে যেতে হবে।
মণীশ মাধবকে দেখে খুশি হয়ে বলে, এই যে ব্রাদার! মদন না এলে মাধবের দেখা পাওয়া যায় না, আমাদের হয়েছে বিপদ। তোমার ফোন নম্বরটা চিরুকে দিয়ে যেয়ো তো।
যাব, কিন্তু আপনি জন্মেও ফোন করবেন না, জানি।