আমি গেরামভারি?
নয়তো কী? লোকেরা বশংবদ হয়ে বসে থাকে, আর তোমরা পায়খানায় বসে খবরের কাগজ পড়ো।
লিডারদের নিয়মই তাই।
এই নাও ব্রাদার! বলে মণীশ খবরের কাগজটা ভাঁজ করে এগিয়ে দেয়, যতক্ষণ না দিচ্ছি ততক্ষণ শান্তিতে চা-টুকু খেতে পারব না।
মদন খবরের কাগজটা খুলতে খুলতে বলে, জামাইবাবু।
উ।
আমি যদি মরে যাই তা হলে কী হবে বলুন তো?
কেউ বিধবা হবে না।
আর কী হবে?
আমার টেলিফোনটাও হবে না।
আঃ, কী হবে না তা জিজ্ঞেস করিনি। কী হবে তাই জানতে চাইছি।
আসলে তুমি মরবে না।
কী করে বুঝলেন?
তোমারই বা মরার কথা মনে হচ্ছে কেন? কোনওকালে তো এসব বলোনি! আমরা জানি তুমি হচ্ছে পজিটিভ লোক। এম পিরা এমনিতেই একটু বেশিরকম আশাবাদী হয়। আজহঠাৎ তোমার হল কী?
মদন খবরের কাগজটা খুলতে খুলতে মৃদু হেসে বলে, মৃত্যুর একটা রোমান্টিক দিক আছে, তাই আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি মরলে কেমন হয়?
কিছুই হয় না হে।–মণীশ মাথা নাড়ে, মরার মধ্যে রোমান্টিক কিছু নেই, মহৎ কিছু নেই। একেবারে মোটা দাগের ক্যাবলা একটা ব্যাপার। আমাদের দেশে গবা পাগলা বলে একটা লোক ছিল। সে গাইত, মনু রে, বাপের খবর রাখলা না, হ্যায় যে মইরা ভ্যাটকাইয়া রইছে পাছায় পড়ছেজোছনা।
অশ্লীল! অশ্লীল!
মোটেই নয়।—মণীশ মাথা নাড়ে, একদম অশ্লীল নয়। পাছায় জোছনা পড়ার ব্যাপারটা বরং খুবই করুণ। মরা-টরার কথা হলেই আমার গানটা মনে পড়ে।
আপনি যা একখানা জিনিস না জামাইবাবু!
মণীশ উঠতে উঠতে বলে, তুমি পেপার দেখো, আমি বরং ততক্ষণে বাথরুমের দখল নিই গে। তুমি পত্রিকা হাতে ঢুকলে তো পাক্কা দেড় ঘণ্টা।
মণীশ বাথরুমে গেলে কিছুক্ষণ একা বসে আপন মনে ফুটুক ফুড়ক করে হাসল মদন। দিনটা আজ ভালই যাবে। সকালে একটা চেঁচামেচি শুনেছে। বউনিটা ভালই বলতে হবে। তারপর এই জোছনার ব্যাপারটা। দুপুরে আজ রাইটার্সে দু’জন মিনিস্টারের সঙ্গে মিটিং আছে। তখন যদি কথাটা মনে পড়ে যায় তা হলে ঠিক ফুড়ক করে হেসে ফেলবে সে। বিকেলে আছে পাটির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। তখনও কি মনে পড়বে?
পত্রিকায় কয়েদি পালানোর কোনও খবর নেই। বাংলা কাগজে এমনিতেই খবর কম থাকে, তার ওপর এসব খবরের এমনিতেই তেমন গুরুত্ব নেই। তবে যারা নবকে জানে তারাই বুঝবে খবরটা কতখানি গুরুতর।
বাইরের ঘর থেকে পরদা সরিয়ে ভিতরের বারান্দায় উকি দিল শ্ৰীমন্ত, দাদা, আপনার বন্ধু এসেছে।
আমি জগবন্ধু। কে এসেছে? নামটা কী?
মাধব হাজরা। ওই যে গোলপার্কের কাছে
আর বলতে হবে না। মাধব দুনিয়ায় একটাই হয়। আসতে বলো।
মাধব বোধহয় বাইরের ঘরে ফিতে বাঁধা জুতো খুলতে খানিক সময় নিল। তারপর ভিতরের বারান্দায় আসতেই তার মুখে উদভ্রান্তিটা প্রথম লক্ষ করে মদন।
তবু মদন সব সময়ে নিজে খোশ থাকতে এবং অন্যকে খোশ রাখতে চেষ্টা করে। হালকা গলায় বলল, মুরগা পেয়েছিস?
কীসের মুরগা?
তোর বাসায় আজ রাতে একটা আস্ত এম পি-র নেমন্তন্ন যে।
ওঃ! আচ্ছা, মুরগি হবে। কিন্তু খবর শুনেছিস?
খবর শোনাই আমার কাজ। নব হাটি পালিয়েছে, এই খবর তো? তা অত ঘাবড়ানোর কী আছে? বোস।
মণীশের পরিত্যক্ত চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে মাধব। তারপর হাঁফ ধরা গলায় বলে, এটা ইয়ারকির ব্যাপার নয়।
এ কথায় সকালের হাসিখুশি ভাবটা মদনের মুখ থেকে মুছে গেল বটে, কিন্তু তার মুখে কোনও ভয় বা ভাবনা ফুটল না। মুখটা আস্তে আস্তে গম্ভীর ও নিষ্ঠুর হয়ে গেল। সে শুধু বলল, হুঁ।
মাধবের চেহারাখানা সুন্দর। দারুণ ফরসা, জোড়া, খুব লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। সুন্দর ছেলেদের সুন্দর বউ জোটে না, সুন্দর মেয়েদের জোটে না সুন্দর বর। মাধবের বউ ঝিনুক কিন্তু সুন্দর। দু’জনেই সুন্দর, দু’জনের সংসার সুন্দর, ফ্ল্যাট সুন্দর। কিন্তু তবুও কোথায় যে ওদের খিচ তা আজও মদন বুঝতে পারল না।
মাধবের চেহারায় আজ তেমন জলুস নেই। সকালে দাড়ি কামায়নি, লম্বা চুলগুলো পাট করা নেই, মুখে বেশ উত্তেজিত ভাব, উৎকণ্ঠা। ডান হাতের মধ্যমায় গোমেদের আংটিটা বারবার ব্যস্ত আঙুলে ঘোরাচ্ছে। বলল, ইউ মাস্ট ড়ু সামথিং।
মদন ধীরে-সুস্থে কাগজের শেষ পাতাটা উলটে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, চা খাবি?
চা!—যেন প্রস্তাবটায় কিছু অস্বাভাবিকতা আছে এমনভাবে বিস্ময় প্রকাশ করল মাধব। তারপর হঠাৎ সচেতন হয়ে বলল, হঁা খাব। দিদি কই?
ঘরে। ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিচ্ছে।
মাধব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে একবার আংটি ঘোরায়, একবার চুলে আঙুল চালায়। হঠাৎ একটু ঝুঁকে বলল, পেপারে কিছু দিয়েছে?
মদন চোখ তুলে বলে, কী দেবে?
নবর ব্যাপারটা?
মদন মাথা নেড়ে পত্রিকাটা ভাঁজ করে রেখে দিয়ে বলে, একজন তৃতীয় শ্রেণির কয়েদির পালানোর খবর তেমন কিছু গুরুতর নয়।
মাধব পিছন দিকে হেলে বসে কয়েক পলক চোখ বুজে থাকে। তারপর বলে, তা বটে। বাট ইট ইজ এ সিরিয়াস নিউজ ফর আস।
মদন মৃদু স্বরে বলে, আস নয়, বল মি। তুইই ভয় খেয়েছিস, আমি নয়।
মাধব চোখ খুলে মদনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলে, তোকে কি নব স্পেয়ার করবে?
মদন মৃদু হেসে বলে, তার চেয়ে বরং জিজ্ঞেস করা ভাল, হোয়েদার আই উইল স্পেয়ার হিম।
মাধবের স্বাভাবিক চোখা চালাক ভাবটা আজ ছুটি নিয়েছে। তবু সে বলল, আমি তোর মতো হিরো নই। অ্যান্টিহিরো।