ও! হ্যাঁ।
এ সময়টায় শ্রীমত্তকে একটু কাছে কাছে রাখবেন। নব লোক ভাল নয়। অবিশ্যি—
মদন উদাস গলায় জিজ্ঞেস করে, অবিশ্যি–
অবিশ্যি নবর এখন আর সেই তেজ নেই নিশ্চয়ই। পুলিশের তাড়া খেয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। এখন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা অবস্থা। তবু…
তবু?
তবু সাবধান থাকা ভাল। আমি কি আর একটু সঙ্গে থাকব দাদা?
নব যদি এসময়ে আসে তবে ঠেকাতে পারবেন?
টেকো হরি গোঁসাই অপ্রতিভ হেসে বলে, আরে আমি ওসব লাইনের লোক তো নই। তবে চেঁচাতে পারব। খুব চেঁচাব–
পারবেন। তবে একটু চেঁচিয়ে শোন তো! দেখি কেমন পারেন।
লজ্জা পেয়ে হরি গোঁসাই বলে, দাদা কী যে বলেন!
তা হলে কী করে বুঝব যে, চেঁচাতে পারেন?
হরি গোঁসাই মাথা নিচু করে লজ্জার গলায় বলে, পারি কিন্তু।
দেখি কেমন পারেন। চেঁচান, খুব জোরে চেঁচিয়ে বলুন, নব আসছে! ওই নব আসছে! খুন, খুন, খুন করে ফেললে! চেঁচান, চেঁচান।–বলে মদন এক পা পিছিয়ে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল হরি গোঁসাইকে।
হরি গোঁসাই বলল, তা হলে বিশুর মেডিকেলে ভর্তি ব্যাপারটা হবে তো!
হবে, হবে। ওর বাপ হবে। নইলে কি আর বিশু আমার পিসু ছাড়বে? এখন চেঁচান দেখি!
হরি গোঁসাই থমকে দাঁড়িয়ে গেল! চোখ বুজে মাথায় আর বুকে বার কয়েক হাত ঠেকিয়ে কোনও দেব-দেবীকে প্রণাম করে নিল। তারপর বুক ভরে দম নিয়ে হঠাৎ আকাশ-ফাটানো গলায় চেঁচাতে লাগল, নব আসছে! ওই নব আসছে! খুন, খুন করে ফেললে-এ-এ-এ-এ-এ
মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কাক ডাকতে লাগল, পাখিরা ঝোপ ছেড়ে প্রাণভয়ে উড়ল, প্রাতঃভ্রমণকারীরা সটাসট দৌড়ে গিয়ে রেলিং টপকাতে লাগল, সামনের এক বাড়িতে দড়াম করে জানালা বন্ধ হয়ে গেল। হরি গোঁসাইয়ের যে এত আওয়াজ তা দেখলে বোঝাই যায় না।
মদন অবাক হয়ে বলল, বাঃ। আপনার গলা তো অ্যাসেট।
বিনীত হাসি হেসে হরি গোঁসাই বলে, আজ্ঞে খুব জোর আওয়াজ হয়। একবার ভিড়ের ট্রেনে শুধু চেঁচিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলাম।
হু। মদন গম্ভীর হয়ে বলে।
আর কি চেঁচাতে হবে দাদা?
মদন মাথা নেড়ে বলে, না। এখন তাড়াতাড়ি সরে পড়া দরকার। যা চেঁচিয়েছেন।
আমি তা হলে আসি?
আসুন। একটু পা চালিয়েই আসুন গিয়ে।
বিশুর তা হলে?
পিস পিসু থাকবে।
বলে মদনও একটু পা চালিযেই পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। কারণ, প্রথম ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে চারদিক থেকে লোক ছুটে আসছে ব্যাপারটা কী তা দেখতে। মদনকে একজন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে দাদা? খুন নাকি? মদন এমনভাবে মাথা নাড়ল যাতে হা’ও হয়, নাও হয়।
একটু বাদে যখন সে জামাইবাবুর মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছিল তখন আর তার মুখে উদাসীনতা ছিলনা। জামাইবাবু মণীশ অখণ্ড মনোেযোগে খবরের কাগজ পড়ছে।
জামাইবাবু।
বলো ব্রাদার।
আপনার চেয়ে খবরের কাগজটা দেখা আমার বেশি দরকার। এবার ছাড়ুন।
তুমি তো এখন পায়খানায় যাবে।
তা গেলেই বা খবরের কাগজ নিয়ে যাব।
যেয়ো। তার আগে যতটা পারি দেখে দিচ্ছি। তোমার ওটা ভারী ব্যাড হ্যাবিট।
কোনটা? খবরের কাগজ পড়াটা?
না, এই খবরের কাগজ নিয়ে পায়খানায় যাওয়াটা।
ব্যাড হ্যাবিট কেন হবে? আমি বরাবর যাই। খবরের কাগজ না হলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না।
দো ইউ আর অ্যান এম পি এবং তোমার সময়ও কম, তবু বলি এটা খুবই ব্যাড হ্যাবিট।
তা হোক। এবার ছাড়ুন।
ছাড়ছি। চা-টা খাও না।
চা ফিনিশ।
তবে চিরু না হয় আর এক কাপ করে দিক। ও চিরু! শুনেছ।
কী অত মন দিয়ে পড়ছেন?
পড়ার কিছু নেই ব্রাদার। সব ছাতমাথায় ভর্তি কাগজ। সেই ছাতমাথাই দেখছি।
আমার প্রেস কনফারেন্সটা দিয়েছে?
দিয়েছে একটুখানি। পাঁচের পাতার তলার দিকে।
হেডিং কী করেছে?
মালদহের অবস্থা ভয়াবহ। তারপর কোলন দিয়ে তোমার নাম।
দুর! পলিটিক্যাল ব্যাপারগুলো দেয়নি তা হলো আপনি যে কেন এত কিপটে!
কেন বলল তো! ত্রিশ টাকা কিলোর চা খাওয়াচ্ছি।
লোকে আরও দামি চা আমাকে খাওয়ায়। চায়ের খোটা দেবেন না। বলছি, মোটে একটা খবরের কাগজ রাখেন কেন?
একটাই পড়ার সময় পাই না।
তা ছাড়া সেই একটাও আবার বাংলা। বাংলা কাগজে খবর কম থাকে জানেন না?
তোমার দিদিও একটু পড়ে যে। ও তো ইংরিজি বোঝে না।
এবার থেকে দুটো করে রাখবেন। ইংরিজিটার দাম আমি প্রতি মাসে মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেব।
এম পি-দের প্রতিশ্রুতির দাম নেই, সবাই জানে। রিস্ক নেওয়াটা কি ঠিক হবে?
চিবু চা নিয়ে এসে মণীশের দিকে চেয়ে বলে, বড় গলায় চায়ের হুকুম দেওয়ার দরকার ছিল না। আমি তো চা করছিলামই।
মণীশ এক গাল হেসে বলে, তা জানতাম। তবু শালার কাছে নিজেকে উদার প্রমাণ করার জন্যই ওটুকু করতে হল।
মদন মুখ গম্ভীর করে বলে, এই বয়সে আর কি নতুন করে আপনার সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাতে পারবেন? আমি যে প্রথম থেকে জানি আপনি ক্রনিক মাইজার।
অথচ দেখো পাড়াপ্রতিবেশিরা সবাই আলোচনা করে, মণীশবাবু টাকা জমাতে জানেন না। কেবল খরচ করেন, কাছা খুলে খরচ করেন।
আপনার পাড়াপ্রতিবেশীরা স্বপ্ন দেখে। এবার খবরের কাগজটা ছাড়ুন।
বড় জ্বালাচ্ছ হে। যাও না, বাইরের ঘরে সেই কাকভোরে এসে সব বসে আছে, গিয়ে তাদের। সঙ্গে দুটো কথা বলে এসো না। ততক্ষণে…
ওরা বসে থাকার জন্যই এসেছে। তাড়া নেই।
তোমরা লিডাররা বাপু বড্ড গেরামভারি।