সতীশ মুখার্জি রোডের পুরনো মসজিদের হাতায় গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কে রে পাখি, না ছাড়ে বাসা-খনার বচন না? বাকিটা মনে নেই মদনের। তবে এইটুকু মনে আছে, ডাকে রে পাখি, নাছাড়ে বাসা।
হ্যাঁ বৃষ্টি। খুব বৃষ্টি হচ্ছে এবার। কিন্তু বৃষ্টি হলে আমি কী করতে পারি? মদনা তো ভগবান নয় বাপ, একজন বুরবক এম পি মাত্র। যা, মানছি এম পিরা অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু তা বলে বানভাসি দেশে ডাঙামি বের করার মতো এলেম তার নেই। তবে মদনা ফিল করে বাপ। ফিল করে। পাখিরা ৪ ডাকছে। মদন একবার পুরনো মসজিদটার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখে নে শালারা এক আস্ত এম পিকে। তেরা হতভাগারা জামাকাপড় পরতে শিখলি না, পার্লামেন্ট বানাতে পারলি না, হেল লাইফ কেঞ্চল কিচমিচ!
মদন গুনগুন করে উ হু হু উ হ হ করে গাইতে লাগল। তার গলায় সুর নেই। তার জন্য পরোয়া করে না সে। উহহ, উহহ করেই যেতে থাকে।
ডান দিকে পার্ক। কতে গিয়ে মদন একটু দাঁড়ায়। শালারা গাছগুলো কেটেছে। বাচ্চাদের জন্য দোলনা ছিল, স্লিপ ছিল, সেগুলো লোপাট করেছে। ঘাসজমিতে টা ফেলেছে। খানিক জায়গা কেটে নিয়ে রঙ্গশালা বানিয়েছে। কারও কিছু করার নেই। ভেসে যাক, ব ভেসে যাক।
মদন পার্কে ঢুকে পড়ে। ভোর েহয়ে এসেছে। পার্কে কিছু ভূতুড়ে রের বা কে মর্নিং ওয়াক সেরে নিচ্ছে। মদন তাদের কক্ষপথে নিজেকে ভিড়িয়ে দেয়। উ হু হু গানটাও চলতে থাকে। এই ভেলো পার্কে বেড়াতে আর কে আনন্দ হচ্ছে। যা, খুব আনন্দ হচ্ছে। আনন্দ। নিজেকে এমপি বলে একেবারেই মনে হচ্ছে না তার।
কিন্তু মনে না পড়ে উপায় আছে? ব্যাটারা পড়িয়ে ছাড়ে। ক্যাংলা চেহারার টেকো একটা লোক গাদি খেলার মতো পথ আটকে একগাল হেসে বলল, দাদা মর্নিং ওয়াক-এ বেরিয়েছেন বুবি?
মদন চিনল। তবে নামটা মনে পড়ল না। বলল, এই একটু। তা কী খবর?
আমাকে চিনতে পারছেন তো! আমি হরি গোঁসাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। কী খবর?
আজ্ঞে কালকে স্টেশনে যে সেই কথাটা বলেছিলাম, মনে আছে?
কোন কথাটা?
আমার বিশুকে যদি একটু মেডিকেলে চান্স করে দেন।
মদন টেকো হরি গোঁসাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে উদাস চোখে পুবের আকাশের দিকে চেয়ে বলে, কী সুন্দর দেখেছে?
ব্যস্ত হয়ে হরি গোঁসাই বলে, আজ্ঞে কোনটার কথা বলছেন?
এই ভোরবেলাটা।
আজ্ঞে তা আর বলতে! খুব সুন্দর।
এই ভোরবেলায় আপনার মনটা উদাস হয়ে যায় না?
খুব যায়। খুব যায়। আমাদের ওকিটা তো প্রায় গ্রামের মতোই। সেখানে যা একখানা করে ভোর হয় না রোজ, কী বলব দার! মনটাকে একদম বৈরাগী বানিয়ে ছেড়ে দেয়। ফাষ্ট বাস ধরে আসতে আসতে আজও খুব উদাস লাগছিল।
মদন বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, তু দেখুন বিশুরা আমাদের পিছু ছাড়ে না। উদাস হওয়ার ক্ষেপ থাকলেও কেউ আর উদাস হচ্ছি না, বৈরাগীও না।
হরি গোঁসাই মাথা চুলকে বলে, পিসুকথাটা ঠিক বুঝলাম না দাদা। পিসু পোকা না কি?
না, না। পিসু মানে পিছু। বিতর সঙ্গে মিলে যায় বলে পিসু কথাটা বেরিয়ে গেল।
হরি গোঁসাই চিমটিটা ধরল না। গদগদ হয়ে বলল, আপনার পিসু ছাড়লে আমারে চলবে কেন আমরা হচ্ছি এমোরে আনরিকগনাইজড জনসাধারণ। আমার কথাই ধরুন না। সারা জীবনে একজন মাত্র ভি আই পির কাছে কিছুটা ঘেঁষতে পেরেছি। সেই ভি আই পি হলেন আপনি। আত্মীয় স্বজনের কাছে বড় করে আপনার কথা কত বলি। অফিসেও একটু আধটু খা িপাই।
এই পার্কে আমাকে ধরলেন কী করে?
বাসায় গিয়েছিলাম। দিদি বলল, পার্কে এসেছেন।
মদন ধৈর্যশীল লোকটার মুখের দিকে চেয়ে ভোরের স্বচ্ছ হয়ে আসা আলোয় জনসাধারণকেই দেখতে পায়। এই সেই জনসাধারণ যাদের নিয়ে তার বহু কালের কারবার। এই সেই বিশুর বাব যাদের পিছু পিছু একদিন সে ঘুরেছে, আর যারা এখন তার পিছু পিছু ঘোরে।
মদন একটা শ্বাস ফেলে বলে, শীমন্তর কাছে একটা ডায়েরি আছে। তাতে—
তাতে লেখানো হয়ে গেছে। হেঁ হেঁ।
ঠিক আছে, দেখবখন।
দেখবেন। সারা জীবন বড় দুঃখে কষ্টে কেটেছে। বিশুটা যদি ডাক্তার হয় তবে শেষ জীবনটা—
মদন হাসে। বাপদের ছেলেপুলে নিয়ে কত আশাই থাকে! গম্ভীর হয়ে বলে, ও আশা না করাই ভাল।
হরি গোঁসাই হঠাৎ নিভে গেল। মদন উদাস ভাবে চারদিকে চেয়ে হাঁটছে। পিছনে হরি গোঁসাই। বলে, সে কথাটা বশ্য ঠিক।
মদন প্রসঙ্গটা ভুলে গেছে। ভাল মানুষের মতো বলে, কোন কথাটা?
ধন্য আশা কুহকিনী।
ও। হ্যাঁ–
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ! মদন হরি গোঁসাইকে ভুলে গিয়ে উদাস পায়ে হাঁটতে থাকে। এখন আর খুব একটা আনন্দ হচ্ছে না তার। তবে ভালই লাগছে।
পিছন থেকে হরি গোঁসাই গলা খাকারি দিয়ে জানান দিল যে, সে আছে।
দাদার সঙ্গে যে আজ বড় শ্ৰীমন্ত নেই!
পাখিরা অনেকক্ষণ বাসা ছেড়েছে। এখন ঝোপে ঝাড়ে চিড়িক মিড়িক করে ঘুরছে তারা। সূর্য মসজিদ ছাড়িয়ে উঠে পড়ল প্রায়। কলকাতার সব স্নান কুশ্রীতা প্রকট হল। দেখতে দেখতে মদন আনমনে জিজ্ঞেস করে, কে শ্ৰীমন্ত?
আপনার বডিগার্ডের কথা বলছিলাম। দিনকাল তো ভাল না। কালকের খবর শুনেছেন তো?
কীসের খবর? মদনের গলায় এখনও অন্যমনস্কতা।
নব হাটি জেল থেকে পালিয়েছে?
মদন এবার সচেতন হয়। কিন্তু ইচ্ছে করেই অন্যমনস্কতার মুখোশটা পরে থেকে বলে, কে নব যটি?
দাদা সব ভুলে গেছেন। নব হটি মানে যে লোকটা নীলুকে খুন করল। আর যার মা এসেছিল কাল আপনার কাছে ছেলের বউয়ের জন্য চাকরি চাইতে।