ঝিনুক শুধু একজনকেই লক্ষ করেছে। অনুগত, বিশ্বাসী ভক্তের মত, দোতলার এক জানালায় তার কামাই ছিল না কখনও। তবে সে মাঝে মাঝে নেমে আসত, পিছু নিত। বহু দূর ঘুরে উল্টো কি দিয়ে এসে মুখোমুখি হত। তবে সাহসের অভাবে কখনও কথা বলেনি। সেই নীরব ভালবাসা কিশোরী ঝিনুকে বাজে বকুলের মতো ঝরেছে তখন। এক বছর গড়িয়ে যাওয়ার মুখে একদিন ঝিনুক দোতলায় ছেলেটিকে খুঁজে পেল না। একটু অবাক হয়েছিল সে। ছেলেটা গেল কোথায়?
ছেলেটা আসলে কোথাও যায়নি, শুধু জায়গা বদল করেছিল। নীচের তলায় হোস্টেলের কমনরুমে টুকটাক টেবিল টেনিসের আওয়াজ পেয়েছে ঝিনুক। সেই কমনরুমের খোলা জানালায় চোখের কাছে ক্যামেরা তুলে তাক করে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। ঝিনুক তাকাতেই শাটার টিপল। তারপর খুব ভয়-পাওয়া ক্ষীণ গলায় বলল, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না।
ঝিনুক জবাব দেয়নি। আজকালকার ছেলেমেয়ে হলে কবে লটরপটর করে ফেলত। কিন্তু তারা পারেনি। শুধু একটু মনখারাপ হয়েছিল ঝিনুকের। আর দেখা হবে না?
অবশ্য না হলেই বা কী? উঠতি বয়সের সুন্দরী ঝিনুক তার পরেও কত পুরুষের দৃষ্টিতে স্নান করেছে।
কিন্তু বৈশম্পায়ন ঠিক বলেনি। দেখা তো হল। কেউ কাউকে চেনা দিল না। কিন্তু চিনতে পারল ঠিকই। ঘটনাটা মনেই থাকত না ঝিনুকের, যদি সেদিন বৈশম্পায়ন ছবি না তুলত। বড় জানতে ইচ্ছে করে, সেই ছবিটা আজও বৈশম্পায়নের কাছে আছে কি না।
সিগারেটের প্যাকেটটা কিনুক আরও কিছুক্ষণ দেখল চেয়ে। তারপর উঠে গিয়ে ট্রাশ বিন-এ ফেলে দিয়ে আবার সময় শুনল, ফোন বাজছে।
ঝিনি?
হ্যাঁ।
একটা খবর আছে।
কী?
মদন এসেছে।
মদনাটা আবার কে?
আরে মদনা, আমাদের মদনা। এম পি।
তাতে কী হল?
না বলছিলাম, ওকে কাল খেতে বললে কেমন হয়।
সে তুমি বুঝবে। আমি কী বলব?
না, না, মানে বাড়িতে তেমন কোনও ঝামেলা কোরো না। ভাবছিলাম, চীনে রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে যাব।
ভয়টা তো খাবার নিয়ে নয়।
ও হো হো, তুমি যা পাজি হয়েছ না! আচ্ছা, এবার খুব ছোট একটা বোতল খোলা হবে।
সে তুমি খোলো গিয়ে। কাল আমি শুক্তির বাসায় গিয়ে বসে থাকব বিকেলে।
আরে, কী যে মুশকিল। এবার ঝামেলা হবে না, ঠিক দেখো। আরে, আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে। আগের মতো বেহদ্দ ছেলেমানুষ আছি নাকি?
তোমার ফ্ল্যাট, তাতে তুমি যা খুশি করবে। আমার কী? আমি থাকব না।
এই কি প্রেম ঝিনি?
সেটাও তুমি বুঝে দ্যাখো।
এটা প্রেম নয়।
আমি তো প্রেম চাই না।
তা বটে। তুমি সত্যিই প্রেম চাও না। মাধবের একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা হলে ড্রাই হোক?
সে তোমার খুশি।
বিয়ারে আপত্তি নেই তো! ওটা তো মদের ক্যাটাগোরিতে পড়ে না।
ওসব আমি জানি না। মদনার গলা জড়িয়ে ধরে তুমি বদনা বদনা খাও। আমি সং সেজে বসে থাকতে পারব না।
না হয় তুমিও একটু খাবে। স্বাদটা জেনে রাখা ভাল।
আমার স্বাদের দরকার নেই।
আচ্ছা তা হলে ড্রাই। এক্সট্রিমলি ড্রাই। ও কে?
কী একটা জরুরি কথা বলা দরকার যেন মাধবকে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ বলা দরকার। ভীষণ দরকার।
শোনো, একটু ধরে থাকো। জরুরি কথা আছে।
মনে পড়ছে না?
না। তবে পড়বে।
ধরে আছি। তুমি বরং কথাটা মনে করার চেষ্টা না করে বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখে জল দাও। গুনগুন করে একটু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাও। মনটাকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখো। তা হলে হঠাৎ মনে পড়বে।
আঃ, একটু চুপ করো না! এক্ষুনি মনে পড়বে।
চুপ করছি। কিন্তু তুমি একটু অন্য কথা ভাবো না ঝিনি! মনে করো আমরা সেই উশ্রী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে হাঁ করে পরেশনাথ পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছি। তুমি উঠতে ভয় পেয়েছিলে বলে ওঠা হল না। মনে পড়ে?
মোটেই ভয় পাইনি। এক সাধু আমাদের উঠতে বারণ করেছিল।
ওই হল। সাধু ভয় দেখিয়েছিল, আর তুমি ভয় পেয়েছিলে।
সাধু ভয় দেখায়নি। সাবধান করেছিল।
এবার মনে পড়েছে?
কী?
জরুরি কথাটা?
না, কিন্তু মনে পড়বে।
মনে করার চেষ্টা কোরো না। খবরদার। বরং আমাদের সেই বীভৎস মধুচন্দ্রিমার কথাটা মনে করো। নিছক বাঙালি বলে কিছু ছেলে সেবার সমুদ্রের ধারে আমাদের কী রকম হেকেল করেছিল। নতুন বউয়ের সামনে আমি একটু রুস্তম হতে গিয়ে কী রকম…
আঃ, চুপ করো না। ওসব কথা বলে আরও সব গুলিয়ে দিচ্ছ আমার। দাঁড়াও আসছি।
এই বলে ক্র্যাডলের পাশে রিসিভার রেখে দ্রুত পায়ে শোওয়ার ঘরে ঢোকে ঝিনুক। খুব ভাল সুগন্ধ মাখলে তার মন স্বচ্ছ হয়ে যায়। নিউ মার্কেট থেকে কেনা দুর্দান্ত একটা জার্মান সেন্ট আছে। ক্যাবিনেট খুলে বুকে সেইটে দুবার স্প্রে করে ঝিনুক। সম্মোহনের মতো গন্ধ। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।
শিশি জায়গা মতো রেখে উঠে আসতে গিয়ে নীলুর ছবিটা চোখে পড়ল। ভাগ্যিস!
ফোন তুলে ঝিনুক বলে, নীলুকে যে খুন করেছিল তাকে মনে আছে?
একটু চুপ করে থেকে মাধব যখন কথা বলল ফের, তখন সে অন্য মানুষ। এতটুকু রস-রসিকতা নেই গলায়। ধীর স্বরে বলল, আছে। কেন?
তার নামটা কী?
নব হাটি।
সেই নব জেল থেকে পালিয়েছে।
এবার এতক্ষণ চুপ করে থাকে মাধব যে, ঝিনুকের একবার সন্দেহ হয় ওপারে কেউ নেই।
শুনছ?
শুনছি। তোমাকে কে বলল?
শুক্তি।
শুক্তি জানল কী করে?
ওকে বলেছে বিনায়ক।
বিনায়ক কার কাছে খবর পেল?
অত শত জিজ্ঞেস করিনি। তবে মনে হল, খবরটা জরুরি। তোমাকে জানানো দরকার।