- বইয়ের নামঃ নীলু হাজরার হত্যা রহস্য
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. নির্জন এক নদী
০১.
নির্জন এক নদী সারাদিন এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে মৃত্যুর করুণ গান গায়। চারদিকে নিস্তব্ধ এক উপত্যকা, দুধারে কালো পাহাড়ের দেয়াল উঠে গেছে আকাশে। এই বিরলে শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসের মতো হু-হু বাতাস বয়ে যায়। অজস্র সাদা ছোট বড় নুড়ি পাথর চারদিকে অনড় হয়ে পড়ে আছে। খুব সাদা, নীরব, হিম, অসাড় সব পাথরের মাঝখান দিয়ে সেই নদী–উৎস নেই, মোহনা নেই। সারাদিন এখানে শুধু তার করুণ গান, মৃদু বিলাপের মতো। কিছু নেই, কেউ নেই। শুধু হাড়ের মতো সাদা পাথর পড়ে থাকে নিথর হয়ে। উপত্যকা জুড়ে এক মৃত্যুর সম্মোহন। এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে নদী অবিরল গান গেয়ে যায়।
আনমনা আঙুল থেকে আস্ত সিগারেটটা পড়ে গিয়েছিল ফুটপাথে। সিগারেটের আজকাল বড্ড দাম। তার ওপর এটা বেশ দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট। শখ করে কিনে ফেলেছে বৈশম্পায়ন। আনমনেই বৈশম্পায়ন সেটা কুড়োতে নিচু হয়েছিল। শর্মিষ্ঠা দশ পা পেছনে, ছেলের বায়না মেটাতে ফুটপাথের দোকান থেকে মোজা বা গেঞ্জি কিনছে, আর অনবরত মৃদুস্বরে ধমকাচ্ছে ছেলেকে। দশ পা এগিয়ে এসেছে বৈশম্পায়ন। দশ পায়ের বিচ্ছিন্নতা। সিগারেটটা কুড়োতে হাত বাড়িয়েও সে ফিস ফিস করে বলল, ইট উইল নট বি এ ওয়াইজ থিং টু ডু মাইডিয়ার।
কুড়োনো হল না। নতুন একটা যে ধরাবে তাও হল না। এরিয়ালে এসে লাগল সেই মৃত্যু-নদীর গান। সাদা নিথর হিম পাথর সব মনে পড়ে গেল।
ডুমকি এখন অনেক দূরে। কারশিয়াং-এ। ডুমকির জন্য বড় হু-হুঁ করে ওঠে বুক। মানুষ তো পাখি নয় যে, উড়ে যাবে। ডুমকির সঙ্গে এই অনেকটা অসহায় দূরত্ব এই মুহূর্তে ভীষণ টের পায় বৈশম্পায়ন।
দশ পায়ের দূরত্বে শর্মিষ্ঠা এখনও কী যে কিনছে। কই এসো, বলে তাকে এখন একবার তাগাদা দেওয়া যায়। কিন্তু সেরকম কোনও ইচ্ছেই হল না বৈশম্পায়নের। থাক, কিনুক। ছেলে বুবুম একবার ফিরে দেখল বাবাকে। তারপর ঝুঁকে পড়ল দোকানের জিনিসপত্রের ওপর।
বৈশম্পায়নের পকেটে গোদরেজের চাবি। পকেটে হাত পুরে চাবির রিংটা মুঠো করে ধরে থাকে সে কিছুক্ষণ। তার ফ্ল্যাট মোটামুটি নিরাপদ। প্যান্টের চোরা পকেটে বোনাসের দেড় হাজার টাকা। চাবির রিং ধরার ছলে সে দেড় হাজার টাকার ফোলা অংশটাকেও স্পর্শ করে আছে। কিন্তু এরিয়ালে নির্ভুল গানের তরঙ্গ ভেসে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে গোদরেজের চাবির নিরাপত্তা, টাকার মূল্য। বৈশম্পায়ন আর একটা সিগারেট বের করে।
সিগারেটটা ধরানো হল না কিছুতেই। আকাশ এখন কেমন? ছেঁড়া মেঘের তুলো গড়িয়ে যাচ্ছে নীল বেডকভারে। এখনও বৃষ্টির স্যাঁতা ভাব উবে যায়নি ফুটপাথের শান থেকে। শরৎ সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বৈশম্পায়নের। তার প্রিয় হল টাকা, প্রিয় ডুমকি আর বুবুম। প্রিয় হোক বা না হোক অবিচ্ছেদ্য হল ওই শর্মিষ্ঠা। তার আরও কিছু প্রিয় আছে, তবে সবসময়ে একরকম নয়। তার প্রিয় রং সাদা। প্রিয় রাগ হংসধ্বনি। প্রিয় অভ্যাস বসে থাকা বা ঘুম। এই শরতের প্রিয় রোদে বউ আর ছেলেকে নিয়ে পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে তার আগাগোড়া ভারী ভাল লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ..
শর্মিষ্ঠা দোকান থেকে জদা পান মুখে দিয়ে তবে এল। হাতের জালের ব্যাগে দুটো ছোট প্যাকেট। আস্তে আস্তে প্যাকেট বাড়বে। জালের ব্যাগ উপচে পড়বে। আজ তারা বাইরেই কোথাও খেয়ে নেবে! সারাদিনের প্রোগ্রাম
কিন্তু এখন বৈশম্পায়নের কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। চোখের দৃষ্টি একটু অবিন্যস্ত, অস্থির। সে বলল, বাড়ি যাবে?
শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বলল, বাড়ি যাব? এখনও তো কেনাকাটা শুরুই হল না! বলতে বলতেই সে বৈশম্পায়নকে ভাল করে লক্ষ করে এবং গলার স্বর পাল্টে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
ভরা প্যাকেট ঢোকাতে গিয়ে সিগারেটটা দুমড়ে ফেলল বৈশম্পায়ন। চিন্তিত মুখে বলল, খারাপ লাগছে।
তা হলে চলো। ট্যাকসি ডাকি।
ডাকো।
বলে বুবুমের হাত ধরে বৈশম্পায়ন। পরক্ষণেই মনে হয়, ব্যাপারটা অত্যধিক নাটুকে হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর তেমন খারাপ নয় যে, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। কিন্তু বাসায় ফিরলে অন্তত শর্মিষ্ঠার কাছে মুখ রাখতে তাকে অসুস্থতার থিয়েটার করতেই হবে। তা পারবে না বৈশম্পায়ন। বড় অস্থির লাগছে তার, ভয়ানক অস্থিরতা দেখা দেবে।
শর্মিষ্ঠা ট্যাকসি ডাকতে ফুটপাথের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৈশম্পায়ন বলল, শোনো।
কিছু বলছ?
কেয়াতলা চল। মাধবদের বাসায় একটু বসি। হয়তো সেরে যাবে।
শরীর কেমন লাগছে বলো তো!
অস্থির। বোধহয় পেটে গ্যাস-ট্যাস হয়েছে।
শর্মিষ্ঠা জানে, আজকাল স্ট্রোকের কোনও বয়স নেই, এবং মানুষ যখন তখন মরে যায়। দু চোখে ঘনীভূত সংশয় আর ভয় নিয়ে সে স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, বরং কোনও ডাক্তারের চেম্বারে চলো। দেখিয়ে নিয়ে যাই।
বুবুম মুখে আঙুল পুরে উধ্বমুখে বাবাকে দেখছিল। বাবাকে হাতের নাগালে পেলেই বায়না করা তার স্বভাব। কিন্তু এখন সেও কিছু টের পেয়ে গেছে। তিন বছরের বুদ্ধি আজকাল কিছু কম পাকে না। সে চুপ করে চেয়ে ছিল।