সেলামের বহর দেখেই বুঝলাম, দারোয়ানজি ভুল করেছেন। ভেবেছেন, শাজাহান হোটেলের নতুন কোনো আগন্তুক আমি।
গেট পেরিয়ে শাজাহান হোটেলের ভিতর পা দিয়েই মনে হল, যেন নরম মাখনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নিজের চাপে প্রথমে যেন মখমলের বিছানায় তলিয়ে গেলাম, তারপর কোনো স্নেহপরায়ণা এবং কোমলস্বভাবা পরী যেন আলতোভাবে আমাকে একটু উপরে তুলে দিল। পরবর্তী পদক্ষেপে আবার নেমে গেলাম, পরী কিন্তু একটুও বিরক্ত না হয়ে পরম যত্নে আমাকে আবার উপরে তুলে দিল। পৃথিবীর সেরা কার্পেটের যে এই গুণ তা আমার জানা ছিল না; তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সেই অদৃশ্য অথচ সুন্দরী পরী আমার দেহটাকে নিয়ে কার্পেটের টেবিলে কোনো বান্ধবীর সঙ্গে পিপঙ খেলছে।
প্রায় নাচতে নাচতে কার্পেটের অন্যপ্রান্তে যেখানে এসে পৌছলাম তার নাম রিসেপশন। সেখানে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার চোখে সমস্ত রাত্রির ক্লান্তি জমা হয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন-গুড মর্নিং।
একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সুপ্রভাত ফিরিয়ে না দিয়ে, নিজের পরিচয় দিলাম। এইখানে একটা চাকরি পেয়েছি। গত রাত্রে আপনাদের ম্যানেজার মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আজ সকাল থেকে আসতে বলেছিলেন। ওঁর সঙ্গে এখন কি দেখা করা সম্ভব?
চকিতে ভদ্রলোকের মুখের ভাব পরিবর্তিত হল। পোশাকি ভদ্রতার পরিবর্তে মুখে হালকা ঘরোয়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আসুন, আসুন, নমস্কার। Orients oldest hotel welconves its youngest staff! প্রাচ্যের প্রাচীনতম হোটেল তার তরুণতম কর্মচারীকে স্বাগত জানাচ্ছে।
ভয় পেয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভদ্রলোক করমর্দনের জন্যে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার নাম সত্যসুন্দর বোস—অন্তত আমার বাবা তাই রেখেছিলেন। এখন কপালগুণে স্যাটা বোস হয়েছি।
বোধহয় ওঁর মুখের দিকে অনেকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম। স্নেহমাখানো মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, এই পোড়ামুখ দেখে দেখে অরুচি ধরে যাবে। শেষ পর্যন্ত এমন হবে যে আমার নাম শুনলে আপনার গা বমি বমি করবে। হয়তো অ্যাকচুয়ালি বমি করেই ফেলবেন। এখন কাউন্টারের ভিতরে চলে আসুন। শাজাহান হোটেলের নবীন যুবরাজের অভিষেক-কার্য সম্পন্ন করি।
আমি বললাম, মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে একবার দেখা করবার…
কিচ্ছু দরকার নেই। সত্যসুন্দরবাবু জবাব দিলেন।গতকাল রাত্রে উনি আমাকে সব বলে রেখেছেন। এখন আপনি স্টার্ট নিন।
মানে?
মানে ফুল ফোর্সে বলতে গেলে গাড়িতে পেট্রল বোঝাই করে যেমনভাবে স্টার্ট নিতে হয়, ঠিক তেমনভাবে স্টার্ট নিন।
সত্যসুন্দরবাবুর কথার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম। উনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, এ-এ-বির নাম শুনেছেন?
অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল?
হ্যাঁ হ্যাঁ! ওঁদের দুটো কম্পিটিশন হয়। স্পি কম্পিটিশন-কে কত জোরে গাড়ি চালাতে পারে। আর এনডিওরেন্স টেস্ট-কে কতক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালাতে পারে। আমাদের এখানে কিন্তু দুটি মিলিয়ে একটি কম্পিটিশন-স্পিড কাম এনডিওরেন্স টেস্ট। কত তাড়াতাড়ি কত বেশিক্ষণ কাজ করতে পারেন, শাজাহান ম্যানেজমেন্ট তা যাচাই করে দেখতে চান। মিস্টার বোসের পাশের টেলিফোনটা এবার বেজে উঠল। আমার সঙ্গে কথা থামিয়ে, কৃত্রিম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভঙ্গিতে সত্যসুন্দর বোস বললেন, গুড মর্নিং। শাজাহান হোটেল রিসেপশন।…জাস্ট-এ-মিনিট…মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাতারাওয়ালা…ইয়েস..রুম নাম্বার টু থার্টি টু…নো মেনসন প্লিজ…
ওঁর টেলিফোন সংলাপ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সত্যসুন্দর বোস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এখন কান খুলে রেখে শুধু শুনে যান, সময়মতো সব বুঝতে পারবেন, শুধু মরচে পড়া স্মৃতিশক্তিকে ইলেকট্রোপ্লেটিং করে একটু চকচকে রাখবেন। বাকি সবকিছু এমনিতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। যেমন ধরুন রুম নাম্বার। কোন ভিজিটর কোন ঘরে রয়েছে, এটা মুখস্থ থাকলে খুব কাজ দেয়।
রিসেপশন কাউন্টারটা এবার ভালো করে দেখতে লাগলাম। কাউন্টারের ভিতর তিনটে চেয়ার আছে—কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকাটাই রীতি। ভিতরের টেবিলের উপর একটা টাইপরাইটার মেসিনও রয়েছে। পাশে গোটাকয়েক মোটা মোটা খাতা-হোটেল রেজিস্টার। দেওয়ালে একটা পুরনো বড় ঘড়ি অলসভাবে দুলে চলেছে। যেন সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে, ঘড়িটা কোনো উদ্ভট চিন্তায় কুঁদ হয়ে রয়েছে।
সত্যসুন্দর বোস বললেন, ভিতরে চলে আসুন।
আমার মুখের উপর নিশ্চয়ই আমার মনে ছায়া প্রতিফলিত হয়েছিল এবং সেইজন্যই বোধহয় সত্যসুন্দরবাবু বললেন, কী, এরই মধ্যে অবাক হচ্ছেন?
লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলাম, কই? না তো। মিস্টার বোস এবার হেসে ফেললেন। চারিদিক একবার সতর্কভাবে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, এখনও তো শাজাহান হোটেলের ঘুম ভাঙেনি। তখন আরও আশ্চর্য লাগবে।
কোনো উত্তর না দিয়ে কাউন্টারের ভিতরে এসে ঢুকলাম। এমন সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। অভ্যস্ত কায়দায় টেলিফোনটা তুলে নিয়ে, বোস বাঁকা ও চাপা স্বরে বললেন, শাজাহান রিসেপশন। তারপর ওদিককার স্বর শুনেই হেসে বললেন, ইয়েস, স্যাটা হিয়ার! এবার টেলিফোনের অপর প্রান্তের সঙ্গে বোধহয় কোনো রসিকতা বিনিময় হল-মনে হল দুজনেই একসঙ্গে হাসতে আরম্ভ করেছেন।