আমাকে দেখেই বায়রন সায়েব উঠে পড়লেন। বললেন, তুমি যাবার পর অন্তত দশটা সিগারেট ধ্বংস করেছি। ধোঁয়া ছেড়েছি আর ভেবেছি, ভালোই হল। তোমারও ভালো হবে, আমারও!
কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিকে বাঁ দিকে রেখে সেন্ট্রাল এভিন ধরে আমরা শাজাহান হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি।
হাঁটতে হাঁটতে বায়রন সায়েবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে তার কোনো উপকারই করতে পারিনি। হঠাৎ মনে হল, আমি ভালোভাবে চেষ্টাও করিনি। অনেক অ্যাটর্নির সঙ্গেই তো আমার পরিচয় ছিল—সায়েব ব্যারিস্টারের বাবুর অনুরোধ উপেক্ষা করা তঁাদের পক্ষে বেশ মুশকিল হত। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সেদিন কারুর কাছে মাথা নত করিনি। আর আজ বায়রন সায়েবই আমার জীবনপথের দিশারি। বায়রন সায়েব বললেন, তোমার চাকরি হবেই। ওদের ম্যানেজার আমার কথা ঠেলতে পারবে না।
ওই শাজাহান হোটেল—বায়রন দূর থেকে দেখালেন।
কলকাতার হোটেলকুলচূড়ামণি শাজাহান হোটেলকে আমিও দেখলাম। গেটের কাছে খান পঁচিশেক গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও গাড়ি আসছে। দারোয়ানজি বুকে আট-দশখানা মেডেল ঝুলিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর মাঝে মাঝে গাড়ি-বারান্দার কাছে এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছেন। রাতের পোশাক-পরা এক মেমসায়েব টুপ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। তার পিছনে বো-টাই পরা এক সায়েব। লিপস্টিক মাখা ঠোঁটটা সামান্য বেঁকিয়ে ঢেকুর তোলার মতো কায়দায় মেমসায়েব বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। সায়েব এতক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মেমসায়েব সেটিকে নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। দারোয়ানজি সেই সুযোগে বুটের সঙ্গে বুট ঠুকে সামরিক কায়দায় সেলাম জানালেন। প্রত্যুত্তরে ওঁদের দুজনের মাথাও স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো একটু নড়ে উঠে আবার স্থির হয়ে গেল।
দারোয়ানজি এবার বায়রন সায়েবকে দেখতে পেলেন। এবং বিনয়ে বিগলিত হয়ে একটা ডবল সাইজের সেলাম ঠুকলেন।
ভিতরে পা দিয়েই আমার মানসিক অবস্থা যা হয়েছিল তা ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে। হাইকোর্টে সায়েবের দৌলতে অনেক বিলাসকেই দেখেছি। হোটেলও দেখেছি কয়েকটা কিন্তু শাজাহান হোটেলের জাত অন্য। কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন তুলনা চলে না।
বাড়ি নয়তো, যেন ছোটখাটো একটা শহর। বারান্দার প্রস্থ কলকাতার অনেক স্ট্রিট, রোড, এমনকি এভিন্যুকে লজ্জা দিতে পারে।
বায়রন সায়েবের পিছন পিছন লিফটে উঠে পড়লাম। লিফট থেকে নেমেও তাকে অনুসরণ করলাম। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। মে মাসের সন্ধ্যায় যেন ডিসেম্বরের শীতের নমুনা পেলাম।
বায়রন সায়েবের পিছনে পিছনে কতবার যে বাঁ দিকে আর ডান দিকে মোড় ফিরেছিলাম মনে নেই। সেই গোলকবাঁধা থেকে একলা বেরিয়ে আসা যে আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল তা নিশ্চিত। বায়রন সায়েব অবশেষে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন।
বাইরে তকমা পরা এক বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল। সে বললে, সায়েব কিছুক্ষণ হল ফিরেছেন। কিচেন ইন্সপেকশন ছিল। ফিরেই গোসল শেষ করলেন। এখন একটু বিশ্রাম করছেন।
বায়রন মোটেই দমলেন না। কোঁকড়া চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বেয়ারাকে বললেন, বলো বায়রন সায়েব।
মন্ত্রের মতো কাজ হল। বেয়ারা ভিতরে ঢুকে চার সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল। বিনয়ে ঝুঁকে পড়ে বললে, ভিতর যাইয়ে।
শাজাহান হোটেলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মার্কোপোলোকে এই অবস্থায় দেখবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর একটা ছোট্ট আন্ডার প্যান্ট লাল রংয়ের পুরুষালি দেহটার প্রয়োজনীয় অংশগুলোকে কোনোরকমে ঢেকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বস্ত্রস্বল্পতা সম্বন্ধে ওঁর কিন্তু কোনো খেয়াল নেই, যেন কোনো সুইমিং ক্লাবের চৌবাচ্চার ধারে বসে রয়েছেন।
কিন্তু আমাকে দেখেই মার্কোপোলো আঁতকে উঠলেন। এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি, বলতে বলতে উনি তড়াং করে বিছানা থেকে উঠে আলমারির দিকে ছুটে গেলেন। ওয়ারড্রোব খুলে একটা হাফপ্যান্ট বের করে তাড়াতাড়ি পরে ফেললেন। তারপর পায়ে রবারের চটিটা গলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। দেখলাম সায়েবের গলায় মোটা চেনের হার; হারের লকেটটা কালো রংয়ের, তাতে কী সব লেখা। বাঁ হাতে বিরাট উল্কি। রোমশ বুকেও একটা উল্কি আছে; তার কিছুটা গেঞ্জির আড়াল থেকে উঁকি মারছে।
ভেবেছিলাম বায়রন সায়েবই প্রথম কথা পাড়বেন। কিন্তু ম্যানেজারই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন। সিগারেটের টিনটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো খবর আছে নাকি?
বায়রন মাথা নাড়লেন। এখনও নেই। একটু থেমে আবার বললেন, কলকাতা একটা আজব শহর, মিস্টার মার্কোপোলা। আমরা যত বড় ভাবি কলকাতা তার থেকে অনেক বড়।
মার্কোপোলোর মুখের দীপ্তি এবার হঠাৎ অর্ধেক হয়ে গেল। বললেন, এখনও নয়? আর কবে?—আর কবে?
পুরনো সময় থাকলে ওঁর হতাশায় ভরা কণ্ঠ থেকে কোনো রহস্যের গন্ধ পেয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়তাম। কিন্তু এখন কোনো কিছুতেই আমার আগ্রহ নেই; সমস্ত কলকাতা রসাতলে গিয়েও যদি আমার একটা চাকরি হয়, তাতেও আমি সন্তুষ্ট।
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বায়রন এবার কাজের কথাটা পাড়লেন। আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, একে আপনার হোটেলে ঢুকিয়ে নিতেই হবে, আপনার অনেক কাজে লাগবে।