কে? আমরাই তো অন্য লোকের কাছ থেকে কে নিয়ে থাকি। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে, বায়রন সায়েব নিজেই বললেন, যে কোনো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের প্রয়োজন হলে আমাকে পাওয়া যেতে পারে।
বায়রন আরও বললেন, এনি কেস্। সে কেস্ যতই জটিল এবং রহস্যময় হোক না কেন, আমি তাকে জলের মতো তরল এবং দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ করে দেব।
আমি বললাম, আমার হাতে এখন কোনো কেস্ নেই।
টুপিটা মাথায় চড়িয়ে বায়রন উঠে পড়লেন। দ্যাটস্ অল রাইট। দ্যাটস অল রাইট। কিন্তু কেউ বলতে পারে না—কবে, কখন আমাকে দরকার পড়বে। তোমার দরকার না পড়ুক, তোমার ফ্রেন্ডদের দরকার পড়তে পারে।
সেই জন্যই বায়রন সায়েব আমাকে একটা কার্ড দিলেন। ওঁর নাম লেখা আছে–B. Byron, your friend in need. টেলিফোন নম্বর : তার পাশেই লম্বা দাগ। কিন্তু কোনো নম্বর নেই।
বায়রন বললেন, টেলিফোন এখনও হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে হবেই। সেই জন্যে জায়গা রেখে দিয়েছি।
বায়রন বলেছিলেন, হবে, ক্রমশ আমার সব হবে। শুধু টেলিফোন কেন, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, মস্ত আপিস হবে। বাবু, ইউ ডোন্ট নো, প্রাইভেট ডিটেটিভ তেমন ভাবে কাজ করলে কী হতে পারে; তোমাদের চিফ জাস্টিসের থেকেও সে বেশি রোজগার করতে পারে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ! এতদিন তো এঁদের কথা শুধু বইতেই পড়ে এসেছি। বর্ণ-পরিচয়ের পর থেকেই কৈশোরের শেষ দিন পর্যন্ত এই শখের গোয়েন্দাদের অন্তত হাজারখানেক কাহিনি গোপনে এবং প্রকাশ্যে গলাধঃকরণ করেছি। ছাত্রজীবনে যে নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে ব্যোমকেশ, জয়ন্ত-মানিক, সুব্রত-কিরীটি ও ব্লেক-স্মিথের পুজো করেছি, তার অর্ধেকও যদি যাদব চক্রবর্তী, কে পি বসু, আর নেসফিল্ডের সেবায় ব্যয় করতাম, তাহলে আজ আমার এই দুর্দশা হত না। কিন্তু এতদিন কেবল আমারই মনোরাজ্যে এই সব সত্যানুসন্ধানী রহস্যভেদীরা বিচরণ করতেন। এই মরজগতে—এই কলকাতা শহরেই যে তারা সশরীরে ঘোরাফেরা করেন তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
পরম বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সহকারে বায়রন সায়েবকে আবার বসতে অনুরোধ করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, চা পানে আপত্তি আছে কি না।
একবার অনুরোধেই উনি রাজি হলেন। চা-এর কাপটা দেড় মিনিটে নিঃশেষ হয়ে গেল। বিদায় নেবার আগে বায়রন বললেন, আমাকে তা হলে ভুলো না।
আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দাদের আবার কাজের জন্য লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হয় নাকি? আমি তো জানি, গোয়েন্দা যখন ভোরবেলায় লেক প্লেসের বাড়িতে টোস্ট এবং ওমলেট সহযোগে চা খেতে খেতে সহকারীর সঙ্গে গল্প করতে থাকেন, তখন হঠাৎ টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বাজতে আরম্ভ করে। একটু বিরক্ত হয়েই নরম সোফা থেকে উঠে এসে রহস্যভেদী টেলিফোন ধরেন। তখন তাকে শিবগড় মার্ডার কেস্ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। নিহত রাজাবাহাদুরের বিধবা মহিষী কিংবা তার একমাত্র কন্যা নিজে করুণ কণ্ঠে রহস্যভেদীকে অনুনয় করেন, এই কেল্টা আপনাকে নিতেই হবে। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি যা চাইবেন তাই দেব।
কিংবা কোনো বর্ষামুখর শ্রাবণ সন্ধ্যায় যখন কলকাতার বুকে দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে। ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে বেরোবার কোনো উপায় থাকে না; তখন আপাদমস্তক রেন্ কোট চাপা দিয়ে কোনো অজ্ঞাত পরিচয় অতিথি রহস্যভেদীর ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েন। মোটা অঙ্কের একটা চেক টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আগন্তুক তার রহস্যময় অতীতের রোমাঞ্চকর কাহিনি বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন। একটুও বিচলিত না হয়ে, রহস্যভেদী বার্মা সিগারের ধোঁয়া ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলেন, পুলিসের কাছে গেলেই বোধহয় আপনার ভালো হত।
আগন্তুক তখন চেয়ার থেকে উঠে পড়ে তার হাত দুটি ধরে করুণ কণ্ঠে বলেন, প্লিজ, আমাকে নিরাশ করবেন না।
কিন্তু বায়রন সায়েবের একি অবস্থা? নিজেই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছেন।
ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের আদালতী কর্মক্ষেত্রে কত বিচিত্র মানুষের আনাগোনা। ভেবেছিলুম বায়রন সায়েবকে সাহায্য করতে পারব। আমারই অনুরোধে আমারই কোনো পরিচিত জনের রহস্য ভেদ করে বায়রন সায়েব হয়তো ভারত-জোড়া খ্যাতি অর্জন করবেন। তাই তাকে বলেছিলাম, মাঝে মাঝে আসবেন।
বার্নিশ করা কালো চেহারা নিয়ে বায়রন সায়েব আবার টেম্পল চেম্বারে এসেছিলেন। এবার ওঁর হাতে কতকগুলো জীবনবীমার কাগজপত্র। প্রথমে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। সামান্য কয়েক মাসের চাকরি-জীবনে আমাকে অন্তত দুডজন এজেন্টের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। আড় চোখে বায়রন সায়েবের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের কর্তব্য স্থির করছিলাম। কিন্তু বায়রন যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। চেয়ারে বসে বললেন, ভয় নেই, তোমাকে ইন্সিওর করতে বলব না।
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ দিয়েই বায়রন বললেন, ডিটেকটিভের কাজ করতে গেলে অনেক সময় বহুরূপী হতে হয়। ইন্সিওরের দালালিটাও আমার মেকআপ। .
বায়রন সায়েবের জন্য চা আনিয়েছে। চা খেয়ে উনি বিদায় নিয়েছেন।
সত্যি আমার লজ্জা লাগত। যদি ওঁর কোনো উপকার করতে পারতাম তাহলে বিশেষ আনন্দিত হতাম। কিন্তু সাধ থাকলেই সাধ্য হয় না, কোনো কাজই জোগাড় করতে পারিনি। ছোকাদাকে বলেছিলাম, আপনাদের কোনো এনকোয়ারি থাকলে বায়রনকে দিন না।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোকাদা বলেছিলেন, তোমার হালচাল তো সুবিধে মনে হচ্ছে না, ছোকরা। ওই টেসসা সায়েবের জন্য তোমার এত দরদ কেন? খুব সাবধান। এলিয়ট রোডের ওই মালেদের পাল্লায় পড়ে কত ছোকরার যে টুয়েলভ-ও-ক্লক হয়ে গিয়েছে তা তো জানেন না।