কিন্তু আমার ভুল ভাঙল। শুনতে পেলাম, দারোয়ানজি বলছেন, কেয়া সমঝা তুম?
দারোয়ানজিকে আমি ভুল বুঝেছি। কেয়া সমঝা তুম? তুমকো দেখকে হামারা দুখ হুয়া।…তুমি ভেবেছো কি? পয়সার জন্য তোমার ঝুড়ি বিক্রি করে দিয়েছি! রাম রাম!
সেদিন আর চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারিনি। পৃথিবী আজও তাহলে নিঃস্ব হয়নি। দারোয়ানজির মতো মানুষরা আজও তাহলে বেঁচে আছেন!
দারোয়ানজি আমাকে কাছে বসিয়েছিলেন। ভাঁড়ে করে চা খাইয়েছিলেন। চা খেতে খেতে আমার পিঠে হাত রেখে দারোয়ানজি বলেছিলেন, খোকাবাবু, ভয় পেও না। স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার নাম শুনেছ? যাঁর ব্রোঞ্জমূর্তি লাট সায়েবের বাড়ির সামনে রয়েছে? তিনিও তোমার মতো একদিন অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন।
দারোয়ানজি বলছিলেন, বাবুজি, তোমার মুখে চোখে আমি সেই আগুন দেখতে পাচ্ছি। তুমিও একদিন বড় হবে, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মতো বড়।
দারোয়ানজির মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থেকেছি। চোখের জলকে তখনও সংযত করতে পারিনি।
যাবার আগে দারোয়ানজি বলেছিলেন, মনে রেখো, উপরে যিনি রয়েছেন, তিনি সর্বদাই আমাদের দেখছেন। সৎপথে থেকে তাঁকে সন্তুষ্ট রেখো। তাকে ঠকিও না।
সেদিনের কথা ভাবতে গেলে, আজও আমি কেমন হয়ে পড়ি। সংসারের সুদীর্ঘ পথে কত ঐশ্বর্য, কত চাকচিক্যের অন্তহীন সমারোহই তো দেখলাম। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুখ, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ্য আজ আমার আয়ত্তের বাইরে নয়। সমাজের যাঁরা প্রণম্য, ভাবীকালের জন্য যারা বর্তমানের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন; শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্যের মাধ্যমে যাঁরা আমাদের যন্ত্রণাময় যুগকে ব্যাধিমুক্ত করার সাধনা করেছেন, তাদের অনেকের নিকটসান্নিধ্যলাভের বিরল সুযোগও আজ আমার করায়ত্ত। কিন্তু ক্লাইভ বিল্ডিংয়ের অখ্যাত আপিসের সেই অখ্যাত দারোয়ান আজও আমার আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে রইলেন। সেই দীর্ঘদেহী পশ্চিমা মানুষটির স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না।
ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে মনে হল দায়োয়ানজী আমাকে বিশ্বাস করলেন, অথচ আমি মিথ্যেবাদী, আমি চোর। প্রতিটি ঝুড়ির জন্য আমি চার আনা বেশি নিয়েছি। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখিনি।
ডালহৌসি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এসেছি চৌরঙ্গীর কার্জন পার্কে। যাদের আপিস নেই, অথচ আপিস যাবার তাগিদ আছে; যাদের আশ্রয় নেই, অথচ আশ্রয়ের প্রয়োজন আছে; সেই সব হতভাগ্যের দুদণ্ডের বিশ্রাম স্থল এই কার্জন পার্ক। সময় এখানে যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানে গতি নেই, ব্যস্ততা নেই, উৎকণ্ঠা নেই। সব শান্ত। ঘাসের ঘনশ্যাম বিছানায় গাছের ছায়ায় কত ভবঘুরে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। এক জোড়া কাক স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার কাঁধে চুপচাপ বসে আছে।
যাঁদের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে কার্জন পার্ক তৈরি হয়েছিল, মনে মনে তাদের প্রণাম জানালাম, কার্জন সায়েবকেও বাদ দিলাম না।
আর স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা? মনে হল, তিনি যেন আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
তাঁর পদতলে বসে আমার ঠোঁট থর থর করে কেঁপে উঠল। হাত জোড় করে সভয়ে বললাম, স্যর হরিরাম, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কোনো দোষ নেই। ক্লাইভ স্ট্রিটের এক স্বল্পবুদ্ধি নিরক্ষর দারোয়ান আমার মধ্যে আপনার ছায়া দেখেছে। আমার কোনো হাত ছিল না তাতে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে অপমান করার কোনো অভিসন্ধিই ছিল না আমার।
কতক্ষণ একভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আপিসের ফাঁকিবাজ ছো্করা কেরানির মতো সূর্যও কখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের দপ্তর গুটিয়ে ফেলে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছেন। শুধু আমি বসে আছি।
আমার কী আছে?
আমি কোথায় যাব?
হ্যাল্লো স্যর। হঠাৎ চমকে উঠলাম।
আমারই সামনে অ্যাটাচি কেস হাতে কোট-প্যান্ট-পরা এক সায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গায়ের রং আমার থেকেও কালো। (মা নিতান্ত স্নেহবশেই আমাকে উজ্জ্বল শ্যাম বলতেন।)
অ্যাটাচি কেসটা দেখেই চিনেছি। বায়রন সায়েব। পার্কের মধ্যে আমাকে ঘুমোতে দেখে বায়রন সায়েব অবাক হয়ে গিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, বাবু!
বায়রন সায়েবের আশ্চর্য হয়ে যাবারই কথা। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে আমার প্রতিপত্তি এক সময় তিনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন।
সেই দিনটার কথা আজও ভুলিনি। বেশ মনে আছে, চেম্বারে বসে টাইপ করছিলাম। এমন সময় অ্যাটাচি কেস হাতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। আবলুস কাঠের মতো রং। কিন্তু সে রংয়েরও কেমন একটা জেল্লা আছে—ঠিক যেন ধর্মতলা স্ট্রিটে চার-আনা-দিয়ে-রং-করা সু।
সায়েব প্রথমেই আমাকে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর আমার বিনা অনুমতিতেই সামনের চেয়ারে এমনভাবে বসে পড়লেন, যেন আমাদের কতদিনের আলাপ। চেয়ারে বসেই পকেটে হাত ঢোকালেন, এবং এমন এক ব্র্যান্ডের সিগারেট বার করলেন যার প্রতি প্যাকেট সেই দুর্মূল্যের বাজারেও সাত পয়সায় বিক্রি হত।
সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটা ট্রাই করে দেখুন।
আমি প্রত্যাখ্যান করতেই হা-হা করে হেসে উঠলেন। এই ব্রান্ড বুঝি আপনার পছন্দ হয় না? আপনি বুঝি খুব ফেথফুল? একবার যাকে ভালোবেসে ফেলেন, তাকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেন না!
প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, উনি বোধহয় ওই সিগারেট কোম্পানির সেলসম্যান। কিন্তু, আমার মতো অরসিকের কাছে রস নিবেদন করে যে লাভ নেই, এই বক্তব্যটি যখন পেশ করতে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আবার মুখ খুললেন, কোনো কে আছে নাকি?