সেই সময়েই একদিন ডালহৌসি স্কোয়ারের একটা আপিসে গিয়েছিলাম।
মে মাসের কলকাতা। রাস্তার পিচ পর্যন্ত টগবগ করে ফুটছে। দুপুরের রাজপথ মধ্যরাতের মতো জনমানবহীন। শুধু আমাদের মতো কিছু হতভাগা তখনও যাতায়াত করছে। তাদের থামলে চলবে না। তারা এ-আপিস থেকে ও-আপিসে যাচ্ছে, আর ও-আপিস থেকে এ-আপিসে আসছে, যদি কোথাও কিছু জুটে যায়।
ঘামে গায়ের জামাটা ভিজে উঠেছিল—যেন সবেমাত্র লালদীঘিতে ড়ুব দিয়ে উঠে এসেছি। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পথের ধারে ঘোড়াদের জল খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে দেখলাম। কিন্তু আমাদের জন্য কিছু নেই। বেকার ক্লেশ নিবারণ তো আর পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির দায়িত্ব নয়, সুতরাং তাদের দোষ দিতে পারিনি।
একটা বড় বাড়ি দেখে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সামনেই লিফ্ট। লিফটে উঠে হাঁপাচ্ছি। গেট বন্ধ করে লিফটম্যান হাতল ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু হঠাৎ তার নজরে পড়ল, আমার হাতে দুটো ঝুড়ি। এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়েই অভিজ্ঞ লিফ্টম্যানের বুঝতে বাকি রইল না আমি কে। সুতরাং আবার হাতল ঘুরল, লিফ্ট আবার স্বস্থানে ফিরে এল।
আঙুল দিয়ে সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে লিক্টম্যান আমাকে বের করে দিয়েছিল। এবং তার আগে জানিয়ে দিয়েছিল, এই লিষ্ট কেবল সায়েব এবং বাবুদের জন্যে। তোমার মতো নবাববাহাদুরদের সেবা করবার জন্যে কোম্পানি আমাকে মাইনে দিয়ে রাখেনি।
সত্যিই তো, আমাদের মতো সামান্য ফেরিওয়ালার জন্যে কেন লিফট হতে যাবে? আমাদের জন্যে তো পাকানো সিঁড়ি রয়েছে, হেঁটে হেঁটে উপর-তলায় উঠে যাও।
তাই করেছি। কোনো অভিযোগ করিনি—নিজের অদৃষ্টের কাছেও নয়। ভেবেছি, সংসারের এই নিয়ম। উপরে উঠবার লিষ্ট সবার জন্যে নয়।
দিনটাই খারাপ আজ। একটাও বিক্রি হয়নি। অথচ তিন আনা খরচ হয়ে গিয়েছে। এক আনা সেকেন্ড ক্লাশের ট্রামভাড়া, এক আনার আলু-কাবলি। তারপর আর লোভ সামলাতে পারিনি। বেপরোয়া হয়ে এক আনার ফুচকা খেয়ে ফেলেছি। খুব অন্যায় করেছি। ক্ষণেকের দুর্বলতায় এক আনা পয়সা উড়িয়ে দিয়েছি।
আপিসে ঢুকে টেবিলের তলায় তাকিয়েছি। সব টেবিলের তলায় ঝুড়ি রয়েছে। দরজার গোড়ায় এক প্রৌঢ়া মেমসায়েব কাজ করছিলেন। আমাকে দেখেই বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই?
বললাম, ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট। ভেরি গুড ম্যাডাম। ভেরি স্ট্রং, অ্যান্ড ভেরি ভেরি ডেউরেবল।
কিন্তু বক্তৃতা কাজে লাগল না। মেমসায়েব তাড়িয়ে দিলেন। ক্লান্ত পা দুটোকে কোনোরকমে চালিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
আপিসের দরজার সামনে বেঞ্চিতে বসে ইয়া গোঁফওয়ালা এক হিন্দুস্থানি দারোয়ান খৈনি টিপছিলেন। মাথায় তার বিরাট পাগড়ি। পরনে সাদা তকমা। বুকের কাছে ঝকঝকে পিতলের পাতে কোম্পানির নাম জ্বল জ্বল করছে
দারোয়ানজি আমাকে পাকড়াও করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, একটা ঝুড়ি বিক্রি করলে আমার কত থাকে।
বুঝলাম দারোয়ানজির আগ্রহ আছে। বললাম, চার আনা লাভ থাকে।
ঝুড়ির দাম জিজ্ঞাসা করলেন দারোয়ানজি। এবার আর বোকামি করিনি। সোজাসুজি বললাম, পাঁচ সিকে।
দারোয়ানজি আমার হাতের ঝুড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে নিবেদন করলাম, খুব ভালো মানা, একটা কিনলে দশ বছর নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।
ঝুড়িটা হাতে করে দারোয়ানজি এবার আপিসের ভিতরে ঢুকে গেলেন। মেমসায়েব বললেন, আমি তো বলে দিয়েছি ঝুড়ির দরকার নেই। দারোয়ানজি কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, ঘোষবাবুর ঝুড়ি নেই। মিত্তিরবাবুর ঝুড়ি ভেঙে গিয়েছে। বড়সায়েবের ঝুড়িরও রং চটে গিয়েছে। ইস্টক মে ভি দো চারঠো রাখনে কো জরুরৎ রয়েছে।
সুতরাং মেমসায়েবকে হার মানতে হল। আমার একসঙ্গে ছটা ঝুড়ির অর্ডার মিলল।
প্রায় লাফাতে লাফাতে ছাতাওয়ালা লেনে ফিরে এসেছি। আধ ডজন তারের ঝুড়ি এক সঙ্গে বেঁধে, মাথায় করে আপিসে চলে এলাম। দারোয়ানজি বাইরেই বসেছিলেন। আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন।
ঝুড়িগুলো স্টকে পাঠিয়ে দিয়ে, মেমসায়েব বললেন, টাকা তো আজ পাওয়া যাবে না। বিল বানাতে হবে।
ফিরে আসছিলাম। দারোয়ানজি গেটে ধরলেন। রুপেয়া মিলা?
বোধহয় ভেবেছেন, আমি ভাগ না দিয়েই পালাচ্ছি। বললাম, আজ মিলল না।
কাহে? দারোয়ানজি আবার উঠে পড়লেন। সোজা মেমসায়েবের টেবিলে। কথাবার্তায় প্রচুর অভিজ্ঞতা দারোয়ানজির। বললেন, মেমসাব, গরিব আদমী। হরেক আপিস মে যানে পড়তা।
এবার আমার ডাক পড়ল। দারোয়ানজি বীরদর্পে বললেন, পেমেন্টে করোয়া দিয়া। একটা ভাউচারের কাগজ এগিয়ে দিয়ে দারোয়ানজি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সই করতে জানি কিনা। সই না জানলে টিপসই লাগাতে পারি।
আমাকে ইংরেজিতে সই করতে দেখে দারোয়ানজি রসিকতা করলেন, আরে বাপ, তুম আংরেজি মে দস্তখত্ কর দিয়া?
টাকাটা হাতে করে বেরিয়ে এলাম। দারোয়ানজিদের আমার চেনা আছে। কমিশনের ভাগ দিতে হবে। এবং সে ব্যবস্থা তো আমি আগে থেকেই করে রেখেছি।
দারোয়ানজি আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমিও প্রস্তুত ছিলাম। দেড় টাকা ওঁর দিকে এগিয়ে বললাম, এই আমার কমিশন। যা ইচ্ছে হয়…।
সঙ্গে সঙ্গে এমন যে হতে পারে আমার জানা ছিল না। দারোয়ানজির সমস্ত মুখে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিল। আমার বেশ মনে আছে, বিশাল বনস্পতির মতো ওঁর দীর্ঘদেহটা হঠাৎ কাঁপতে আরম্ভ করল। রাগে, অপমানে সমস্ত মুখ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।
আমি ভাবলাম, বোধহয় ভাগ পছন্দ হয়নি। বলতে যাচ্ছিলাম, বিশ্বাস করুন, দারোয়ানজি, ছটা ঝুড়িতে আমার দেড় টাকার বেশি থাকে না।