সন্ধ্যাবেলায় লিজার বাড়িতে গিয়ে মার্কো কড়া নেড়েছেন। ভিতর থেকে লিজা বললে, ও ডার্লিং, তুমি তা হলে এসেছ! আর এক মিনিট। আমি প্রায় রেডি।
সেই এক মিনিট ওয়েলেসলির ওই নোংরা গলিটার বদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মার্কো নিজেকে অভিশাপ দিয়েছে।
দরজা খুলে লিজা এবার বেরিয়ে এল। লিজাকে যেন চেনাই যায় না। সত্যই বারোয়ারি অভিসারে চলেছে যেন সে। কী উগ্র প্রসাধন! সস্তা সেন্টের গন্ধে গা ঘুলিয়ে ওঠার অবস্থা। পুরো এক টিন পাউডারই লিজা বোধহয় আজ মুখে মেখেছে। তার উপর আবার লাল রং।
রাস্তায় বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ডাকলেন মার্কো। ট্যাক্সিতে চড়ে বললেন, কোথায় যাবেন? চাঙ্গুয়া?
না। আজ বড় কোথাও যাব, লিজা বলেছে। তাহলে গ্র্যান্ড কিংবা গ্রেট ইস্টার্নে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন। লিজা আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়ল। আজ লিজার মন নাচছে শাজাহান হোটেলের জন্য। সৈন্যবাহিনীর লোকরা ডাইনিং হল্টা হয়তো বোঝাই করে রেখে দিয়েছে, তবু চেষ্টা করে একটা জায়গা করে নেওয়া যাবে।
হোটেল শাজাহান। অনেকদিন আগে লিজা ওখানে এসেছিল। সত্য বলে মনে হয় না, যেন ড্রিমল্যান্ড। সাত টাকা আট আনা একটা ডিনারে নেয় বটে, কিন্তু অদ্ভুত। একটা মেনুকার্ড চুরি করে এনেছিল লিজা। কতদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিজা সেই কার্ডটা পড়েছে-Pamplemous a Sajahan; Couson Ajoblanco Beckti Allenby, Barot dvos Roti, Gateau Citrol, Cafe Noir
আরও কত কী!
শাজাহান হোটেলের নীলাভ আলোয় রাত্রি তখন দিন হয়ে উঠেছিল। হোটেলের অতিথি হয়ে কেমন যেন লাগছিল। অভিনেতা যখন দর্শক হয়ে নাটক দেখেন তখন মনের অবস্থা বোধহয় এমনই হয়।
মদ খেতে চেয়েছিল লিজা। মদের অর্ডার দিয়েছিলেন মার্কোপোলো। ব্র ককটেল—জিন, ফ্রেঞ্চ ভারমুথ, ইটালিয়ান ভারমুথ আর কমলালেবুর রস। সাড়ে পাঁচ টাকা পেগ।
ব্রঁ ককটেল শেষ করে কাঁচা হুইস্কি। মদ খেতে খেতে লিজা বলেছিল, আই অ্যাম স্যরি। আপনাকে বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারলাম না। টাকাটা আমার প্রয়োজন। আমার দিনকাল সুশানের মতো ভালো নয়। আর তা ছাড়া সুশানের যখন অনেক টাকা রয়েছে, তখন কেন সে দেবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, যেমন বলেছেন ঠিক তেমন কাজ করব।
লিজা এবার মার্কোর মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণভাবে হাসল। হাসতে তবে যেন ওর বয়সটা বোঝা গেল। ওর চোখের কোলে কালো দাগগুলো দেখলে, যত বয়স মনে হয়, আসলে তার থেকে অনেক বয়স কম।
লিজা নিজেই বললে, সেই যে পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিলাম এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হলাম না। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। বেশিক্ষণ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারি না। সেদিন একজন কাস্টমার চিঙ্কার করে কী বললেন, জানেন?
কী? ইচ্ছে না থাকলেও মার্কোকে জিজ্ঞাসা করতে হল। খু
ড়ি এবং বুড়ি। বেঙ্গলি কাস্টমারগুলোনরকের ডাস্টবিন।
আর একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে লিজা বললে, ঠিক করেছি, এবার থেকে কর্পোরেশনের বার্থ সার্টিফিকেটটা সব সময় বডিসের মধ্যে রেখে দেব। কেউ কিছু বললে, সার্টিফিকেটটা বার করে মুখের উপর ছুঁড়ে দেব।
উত্তর না দিয়ে মার্কো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কেসের জন্যে আমি একটা পয়সাও সুশানের কাছ থেকে নিচ্ছি না।
সিলি ওল্ড ফুল। তুমি এখনও বোকা রয়ে গেছ। তোমার কিছু বুদ্ধি হয়নি। মদের গেলাসটা চেপে ধরে লিজা বলেছিল।
মার্কো সেই রাত্রেই লিজাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর সামান্য যা আছে, তা অ্যাটর্নিকে দিয়ে যেতে হবে। ওখানে ফিরে গিয়ে আপনাকে আবার কিছু পাঠাব।
মামলার খরচের টাকাও অ্যাটর্নির ঘরে জমা পড়েছিল। চরিত্রহীনতার অভিযোগে মার্কোপোলোর বিরুদ্ধে সুশানের বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন আদালতে পেশ করাও হয়েছিল।
আবেদন সই করবার দিনে অ্যাটর্নি বলেছিলেন, একটা ব্যাপারে আপনাদের সাবধান করে দেওয়া প্রয়োজন। পিটিশনে বলতে হয়, ডাইভোর্স পাবার জন্য দুপক্ষের মধ্যে কোনো যোগ-সাজশ নেই। আমরা বলি কলিউশন। যদি কোর্ট একবার সন্দেহ করেন এর পিছনে সাজানো কোনো ব্যবস্থা আছে তা হলেই বিপদ। কেউ যেন না জানে, মামলা করবার জন্য সুশানের টাকা আপনি দিয়ে গিয়েছেন। আজ থেকে আমরা আমাদের মক্কেল হিসেবে সুশানকেই শুধু চিনি; আপনাকে আমরা দেখিনি, জানি না। ভুলেও আমাদের কাছে কোনো চিঠি-পত্তর লিখবেন না।
এই পর্যন্ত বলে বায়রন একটু থামলেন। এলিট রোড থেকে বেরুনো একটা নোংরা গলির অপরিচিত পরিবেশে যে বসে আছি তা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আধুনিক মার্কোপোলোর দুঃখের ইতিহাসের ছবি মেট্রো সিনেমাতে দেখছিলাম।
বায়রন সায়েব বললেন, এর পরের ঘটনার জন্যে সত্যি দুঃখ হয়। মার্কোপোলো যদি তখন আপনার সায়েবের কাছে যেতেন।
লাভ হত না। আমি বললাম। স্বামী-স্ত্রীর যোগ-সাজশের মামলা তিনি কিছুতেই নিতেন না।
তা হয়তো নিতেন না। কিন্তু অন্য একটা পথ বাতলে দিতেন। বায়রন সায়েব বললেন।
তা হয়তো পারতেন। আমি বললাম।
যা হোক, কাটা দুধের জন্য শোকাশ্রু বিসর্জন করে লাভ কী? যা হয়েছিল তাই বলি—
কলকাতার ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করে মার্কোপোলো নিজের কর্মস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে পাঁচশ টাকা জোগাড় করে লিজাকে পাঠিয়েছিলেন; এবং অদূরভবিষ্যতে বাকিটা পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। চিঠি লিখে খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এমন কোনো বন্ধুও ছিল না, যে সমস্ত খবরাখবর জানাবে।