মার্কোপোলোর বাধাবন্ধহীন আদিম গ্রিক রক্ত যেন গরম হয়ে উঠেছিল। তোমার-গান-গাওয়া-পরিচয়ের চাকরি? করুণা?
করুণায় এত ঘৃণা কেন? করুণায় তো ছোটবেলা থেকে এত বড় হয়েছ? সুশান সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল।
উত্তর দেননি মার্কোপোলো, মেজর স্যাননের আসবার সময় বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। এক বোতল বীয়ার নিয়ে মার্কোর জন অপেক্ষা করে মেজর স্যানন শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছেন।
কিছুদিন পরে সুশান বলেছে, দুপুরেও একটা সুযোগ পাচ্ছি। লাঞ্চের সময় গাইবার জন্য ম্যানেজমেন্ট ধরাধরি করছে। আরও শ তিনেক টাকা বেশি দেবে।
মার্কোপোলো উত্তর দেননি। পরে একদিন জিজ্ঞাসা করেছেন, এইজন্যই কী তুমি গানের সাধনা করেছিলে, সুশান?
যারা গান যায়, তাদের স্বপ্ন কী? সুশান পালটা প্রশ্ন করেছে। এবং মার্কোর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিয়েছে, তারা চায় জনপ্রিয়তা। তা আমি পেয়েছি। আমি পপুলার।
একটা চাকরির সন্ধানে মার্কোপোলো পাটনায় গেলেন। চাকরি পেলেন, কিন্তু সেখানে মন ভরল না। পাটনা থেকে সোজা করাচি। ওখানকার একটা বড় হোটেলে অবশেষে চাকরি পাওয়া গিয়েছে।
চাকরি পেয়ে করাচি থেকে সুশানকে মার্কোপোলো চিঠি লিখেছেন। সুশান লিখেছে, দিন-রাত্তির যে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে জানি না। সবসময় শুধু গান গাইছি। পৃথিবীর লোকেরা এত গান ভালোবাসে!
মার্কোপোলো লিখেছেন, এখানকার পরিবেশটা সুন্দর। তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। তাছাড়া শহর কলকাতা থেকে অনেক সাজানো-গোছানো। জাপানি বোমা পড়বার ভয়ও নেই।
সুশান লিখেছে, কলকাতার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যারা একদিন দশ টাকা দিত না, তারাই হাজার টাকা দিচ্ছে। আর একটা রেস্টুরেন্ট আরও বেশি লোভ দেখাচ্ছে।
মার্কোপোলো লিখেছেন, তোমার জন্য মন কেমন করছে!
সুশান উত্তর দিয়েছে, ছুটি নিয়ে চলে এস। বড়জোর কয়েকদিনের মাইনে দেবে না।
করাচি থেকে চিঠি এসেছে, নতুন চাকরি; ছুটি নেব বললেই নেওয়া যায় না। হোটেলে অতিথি বোঝাই। অথচ দায়িত্বসম্পন্ন লোকের অভাব। তার থেকে তুমি চলে এস। গাইয়েদেরও তো বিশ্রাম দরকার!
কলকাতা থেকে উত্তর গিয়েছে, তোমার চিঠি পেলাম। আমেরিকান বেস-এ গান গাইবার জন্য বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে ছসপ্তাহের জন্য ভ্রমণে বেরোচ্ছি। স্যরি।
ছুটির চেষ্টা করেছেন মার্কোপোলো। কিন্তু পাননি। যখন ছুটি মিলল, তখন একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে।
ছুটিতে কলকাতায় এসে মার্কোপোল অবাক হয়ে গিয়েছেন। তার স্ত্রীর বাড়িঘরদোর কিছুই চেনা যাচ্ছে না। যে-বাজারে গাড়ির একটা টায়ার পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না, সেই বাজারে গাড়ি কিনেছে সুশান!
আমাকে জানাওনি তো। মার্কোপোলো বলেছেন।
ওহহা স্যরি, তোমাকে জানানো হয়নি। খুব সস্তায় পেয়ে গিয়েছি। মেজর স্যানন জোগাড় করে দিয়েছেন।
নিজের চোখে মার্কোপোলো যা দেখলেন, তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। টাকা…সস্তা কেরিয়ার…সুশানের কাছে ওইগুলোই বড় হল? নিজের শিল্পের কথা, নিজের সাধনার কথা একবার ভেবে দেখলে না।
কিন্তু উপদেশ বর্ষণ করে লাভ কী? বাঘিনি রক্তের আস্বাদ পেয়েছে। সুশানের বাড়ির সামনে মিলিটারি অফিসারদের গাড়িগুলো প্রায় সর্বদাই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
একান্তে সুশানকে ডেকে মার্কোপোলো বলেছেন, তুমি কি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখেছ?
নিশ্চয় দেখেছি, রোজই দেখছি। একটু মোটা হয়েছি, এই যা। সুশান উত্তর দিয়েছে।
তোমার চোখ দুটো?
একটু বসে গিয়েছে। এমন পরিশ্রম করলে ম্যাডোনারও চোখ বসে যেত।
তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, আমাকে জানতে হবে সুশান। মার্কোপোলো গম্ভীরভাবে বলেছেন।
ভেরি ব্রাইট প্ল্যান, সুশান উত্তর দিয়েছে। রেস্তোরাঁর চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। ওতে লস। তার থেকে থিয়েটার রোডের এই বাড়িটাতে বসে বসে গান গাইব, সঙ্গে কিছু খাবার ব্যবস্থা থাকবে। মেজর স্যানন একটা বার লাইসেন্স জোগাড় করে দেবেন কথা দিয়েছেন। যাকে তাকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব না। শুধু সিলেক্টেড গেস্টদের আপ্যায়ন করব। আর তুমি যদি সব দেখাশোনার দায়িত্ব নাও, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে গান নিয়ে পড়ে থাকতে পারি।
হোয়াট? সুইস কলেজ অব কেটারারস থেকে পাস করে আমি কৰ্গার্লের ম্যানেজার হব! গড় হেল্প মি!
সেই রাত্রেই মার্কোপোলো বুঝেছিলেন, আর হবে না।
ঘৃণায় ধর্মভীরু মার্কোপোলোর সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠেছিল। গভীর রাত্রে থিয়েটার রোডের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে পরমপিতাকে মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন এমন হল? এমন শাস্তি তাকে কেন পেতে হল?
ভোরবেলায়, ব্রেকফাস্ট টেবিলে মার্কোপোলো সুশানকে জানিয়ে দিলেন, আর এক সঙ্গে নয়, এবার ছাড়াছাড়ি।
ডাইভোর্স! সুশান প্রথমে রাজি হয়নি। আমার হাজব্যান্ড আছে বলে, আনডিজায়ারেবল এলিমেন্টরা ডিসটার্ব করতে সাহস পায় না। আমেরিকান মিলিটারি পুলিসও আমার ফ্ল্যাটে অফিসারদের যাতায়াতে বাধা দেয় না। আমার সম্মানজনক পেশাটা নষ্ট না করলে, তোমার বুঝি রাত্রে ঘুম হচ্ছে না?
বিচ্ছেদ তো হয়েই রয়েছে। এবার কেবল আইনের স্বীকৃতি। মার্কোপোলো বলেছেন।
তার মানে তুমি কোর্টে আমার নামে অ্যাডালটারির অভিযোগ আনবে? তুমি বলবে, আমি পরপুরুষে আসক্ত?
এ-দেশের চার্চে বিয়ে হলেও, এ-দেশের আইন জানবার সময় বা সুযোগ কোনোটাই মার্কোপোলোর ভাগ্যে জোটেনি। এদিকে ছুটি ফুরিয়ে আসছে। যা-হয় একটা কিছু করে, এই পাপের শহর থেকে চিরদিনের মতো পালিয়ে যাবেন বিদেশি মার্কোপোলো।