অনেক কষ্টে সুশান এইখানে ঢুকেছে। প্রথমে বেশ কষ্ট হত। সারাদিন দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেক বিক্রি করে, সোজা এখানে চলে আসতে হয়। এখানেই জামাকাপড় বদলিয়ে সে তৈরি হয়ে নেয়; বাড়িতে ফিরে যাবার সময় থাকে না। অথচ এমন প্রমোদনিকেতন যে লেডিজ টয়লেট-এর কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন চাপরাশিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বারোয়ারি ল্যাভেটরি ব্যবহার করতে হয়। দুর্গন্ধে মাঝে মাঝে বমি হয়ে যাবার অবস্থা হয়।
এরা তোমায় কিছুই দেয় না? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।
রাত্রের খাওয়াটা পাওয়া যায়। আর মাসে দশ টাকা। সুশান বলেছে।
মাত্র দশ টাকা! ডিসগ্রেসফুল। ছারপোকার জাত এরা! মার্কোপোলো উত্তেজিত হয়ে বলেছেন।
তা-ও বা কদিন? সুশান বিষণ্ণভাবে বলেছে। মানে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।
এখানে যে গান গাইত, তার নাম লিজা। পা ভেঙে সে বিছানায় পড়ে রয়েছে, তাই আমাকে গান গাইতে দিয়েছে। ডাক্তার লিজার পায়ের প্লাস্টারটা খুলে দিলেই আমার দিন শেষ হয়ে যাবে।
সুশানের জন্য মার্কোপোলো দুঃখ অনুভব করেছেন। ওরও যে বাবা-মা ছিল না, ভাবতেই সুশানের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করেছেন। রূপ তার তেমন ছিল না। যৌবন হয়তো ছিল; কিন্তু কেবল যৌবনের সেই পাতলা দড়ি দিয়ে মার্কোর মতো সমুদ্রগামী জাহাজকে বেঁধে রাখা সুশানের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হত না।
কিন্তু মার্কোপোলো নিজেই ধরা দিলেন। বাঁধা পড়লেন। স্বেচ্ছায় একদিন সুশানকে বধূরূপে হোটেলে এনে তুললেন।
এই সুশানের জন্যই মার্কোপোলোকে শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়তে হল। এখানে ওকে সবাই জেনে গিয়েছে। এখানে থেকে ওর পক্ষে বড় হওয়া সম্ভব নয়। পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় যে একবার নিজের গান বিক্রি করেছে, তার পক্ষে চৌরঙ্গীর জাতে ওঠা আর সম্ভব নয়।
চেষ্টা করে রেঙ্গুনে চাকরি জোগাড় করলেন মার্কোপোলো। ম্যানেজারের চাকরি। এবার ওঁদের আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ থাকবে না। সেখানের কেউ আর সুশানের পুরনো ইতিহাস খুঁজে পাবে না।
কলকাতার হোটেলওয়ালারা মার্কোপোলোকে বলেছিল, এত ব্যস্ত কেন, এখানেই একদিন তুমি ম্যানেজার হবে।
মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। কলকাতা আমার শ্বশুরবাড়ি বটে, কিন্তু বাপের বাড়ি নয়। আমার কাছে রেঙ্গুনও যা কলকাতাও তাই।
কিছুদিন ওখানে মন্দ কাটেনি। সুশান তার স্বপ্ন আর মার্কো তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হোটেলটাকে ছবির মতো করে সাজিয়ে তুলবেন। বিদেশি আগন্তুকরা এসে অবাক হয়ে যাবেন। বার্মাতে যে এমন হোটেল থাকা সম্ভব, ভেবে পাবেন না।
কিন্তু রেঙ্গুনের আকাশে একদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান দেখা গেল। জাপানিরা আসছে।
বার্মা ইকুয়েশন। এমন যে হতে পারে, কেউ জানত না। এমন অবস্থার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না—মার্কোপোলোও না।
শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত রাস্তায় হারিয়ে ওঁরা দুজন কলকাতায় ফিরে এলেন। এর আগেও, শৈশবে মার্কোপোলো একবার রিফিউজি হয়েছিলেন। কিন্তু তখন অন্যজনের করুণায় জীবন রক্ষা হয়েছিল। এখন নিজের ছাড়াও আর একটা জীবন-সুশানের জীবন-তার উপর নির্ভর করছে।
যাঁরা একদিন তাকে রাখবার জন্য পেড়াপাড়ি করেছিলেন, তারাই আজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তার উপর ইতালীয় গন্ধ আছে বলে অনেকে নাক সিটকাল। ইতালিয় বলে মার্কোকে কলকাতার লোকেরা হয়তো জেলখানায় পাঠাত, যদি না তাঁর পকেটে গ্রিক পাসপোর্ট থাকত। ফাদারেরা ওই একটি দুরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন—নাম পালটালেও, তাঁরা মার্কোর জাত পালটাননি।
কলকাতার বাজারে মার্কোপোলোর দাম নেই; কিন্তু সুশানের চাহিদা বেড়েছে। হাজার হাজার ইংরেজ এবং আমেরিকান সৈন্যে দেশটা ভরে গিয়েছে। তারা রেস্তোরাঁয় খেতে চায়; এবং খেতে খেতে গান শুনতে চায়।
মার্কোপোলো আপত্তি করেছিলেন। ওইভাবে গান গাইলে, তুমি কোনোদিন আর জাতে উঠতে পারবে না। তোমাকে যে অনেক বড় হতে হবে। একদিন বিশ্বসুদ্ধ লোক তোমার গান শুনতে চাইবে; তোমার রেকর্ড ঘরে ঘরে বাজবে।
সুশান বললে, কিন্তু ততদিন? ততদিন কি না খেয়ে থাকব? যারা একদিন দশ টাকা দিতে চায়নি তারাই পঁচিশ টাকা নিয়ে সাধাসাধি করছে। লিজা পালিয়েছে ওখান থেকে। গান না থাকলে, মিলিটারিরা খেপে যাবে।
বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিলেন মার্কোপোলো। যে-স্বামীর খাওয়াবার মুরোদ নেই, তার তো ফোঁস দেখিয়ে লাভ নেই।
মার্কোপোলো নিজের চাকরি খুঁজছেন। আর সুশান গান গাইছে।
একদিন সুশান বললে, একটা ঘড়ি কিনেছি জানো?
টাকা পেলে কোথায়?
সুশান বলে, টাকার অভাব নেই। আমার গান শুনে খুশি হয়ে একদল আমেরিকান অফিসার সেদিন সঁদা তুলে ঘড়ির দাম জোগাড় করে দিয়েছে।
মার্কোপোলো বলেছেন, হুঁ।
এত রাত করে বাড়ি ফের তুমি, আমার ভয় লাগে। মার্কোপোলো বলেছেন।
আগে লাইসেন্স ছিল দশটা পর্যন্ত। এখন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। রাত একটা পর্যন্ত গান গাইতে হয়।
তোমার কষ্ট হয় না? সুশান, এমন গান গাইতে তোমার ভালো লাগে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেন।
কিন্তু ওরা যে টাকা দেয়। অনেক টাকা দেয়, জানো? ক্লান্ত সুশান উত্তর দিয়েছে।
সুশান বলেছে, তোমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করছি। করবে? লিলুয়া মিলিটারি ক্যানটিনের ম্যানেজার। আমার স্বামী শুনে ওরা খুব আগ্রহ দেখিয়েছে। মেজর স্যানন আগামিকাল তোমার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করতে আসবেন।