হোটেল-কলেজ থেকে পাস করে পিতৃমাতৃহীন নিঃসঙ্গ মার্কোপোলো চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। পাস করলেই কিছু বড় চাকরি পাওয়া যায় না। অনেক নিচু থেকে আরম্ভ করতে হয়। আর কাজ শিখতেও সময় লাগে। হোটেলের লোকেরা বলেন, কিচেন জানতেই পাঁচ বছর লাগে। দু বছর শুধু মদের নাম-ধাম এবং জন্মপঞ্জী কণ্ঠস্থ করতে। অরাও দু বছর হিসেব-নিকেশ শিখতে। তারপর বাকি জীবনটা মানব-চরিত্রের রহস্য বুঝতে বুঝতেই কেটে যায়।
মার্কোপোলোর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। চাকরির ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে মার্কোপোলো একদিন কলকাতায় হাজির হলেন। যে-হোটেলের আন্ডারম্যানেজার হয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন, অনন্ত-যৌবনা কলকাতার বুকের উপর সে-হোটেল এখনও নিয়ন ও নাইলনের ভিড়ে উচ্চকিত হয়ে রয়েছে।
ধর্মভীরু এবং কৃতজ্ঞ মার্কোপোলো তার জীবনদাতা রোমান ক্যাথলিক ফাদারদের ভোলেননি। প্রতি রবিবারে শত বাধা সত্ত্বেও চার্চে গিয়েছেন; তাঁর জীবন রক্ষার জন্য পরম পিতার উদ্দেশে শত-সহস্র প্রণাম জানিয়েছেন। সময় পেলে ওরই মধ্যে ট্রেনে করে ব্যান্ডেল চার্চে পর্যন্ত হাজির হয়েছেন।
ভার্জিন মেরীর মূর্তির সামনে রঙিন মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেছেন। হোটেলে থেকে এবং বার-এর তদারক করে যে জীবনের মধ্যে তিনি ঢুকে পড়তে পারতেন, তার থেকে মার্কোপোলো নিজেকে সর্বদা সযত্নে দুরে সরিয়ে রেখে দিয়েছেন।
ওই সময়েই একজন মিস মনরোর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। নিজের হোটেলের হই-হই হট্টগোল থেকে খানিকক্ষণ শান্তি পাবার জন্য মার্কোপোলো পার্ক স্ট্রিটের একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় রাত্রে খেতে গিয়েছিলেন। ওইখানেই সুশান মনরো গান গাইছিল।
মার্কোপোলোর গল্প বলতে বলতে বায়রন সায়েব এবার একটু থামলেন। টেবিল থেকে অ্যাটাচি কেসটা টেনে এনে, একটা পুরনো খবরের কাগজের টুকরো তার ভিতর থেকে বার করলেন। টুকরোটা সযত্নে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো অনেক জায়গায় ঘোরো। এই মেয়েটিকে কোনোদিন কোথাও দেখেছ?
জীবনে যত বিজাতীয় মেয়ে দেখেছি, তাদের সঙ্গে ছবিটা মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই অমন কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।
বায়রন বললেন, অনেক কষ্টে ছবিটা স্টেটসম্যান অফিস থেকে জোগাড় করেছি। সেই সময় একদিন রেস্তোরাঁর মালিক কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সেই সংখ্যাটা টাকা দিয়ে কিনতে হল।
এই পুরনো খবরের কাগজ থেকে সুশান মনরোর সমস্ত রূপটা মানসপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। ভদ্রমহিলা দেখতে এমন কিছু সুন্দর ছিলেন না, বায়রন সায়েব বললেন।
কিন্তু মার্কোপোলোর মনে হল, মৃদুলতার একটা ছন্দিত ভঙ্গি যেন তার চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে।
ডিনার বন্ধ করে মন দিয়ে সুশান মনরোর গান শুনলেন মার্কোপোলো। গান শেষ হলে নিজের টেবিলে গায়িকাকে নিমন্ত্রণ করলেন।
কেমন গান শুনলেন? মিস মনরো ওঁর টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন।
চমৎকার! একদল বিশিষ্ট অন্ধ অতিথির সামনে, আপনি যেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের এক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন।
মেয়েটি হাসল। আস্তে আস্তে বললে, কী করব বলুন, সমজদার শ্রোতা কোথায় পাব?
এই শহরের সব লোক কি কালা? মার্কোপোলো হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।
কালা, কিন্তু কানা নয়! চোখটা খুব সজাগ, দৃষ্টি খুবই প্রখর। এখানকার রেস্তোরাঁ মালিকরা তা জানেন, তাই শ্রোতব্য শব্দ থেকে গায়িকার দ্রষ্টব্য অংশের উপর বেশি জোর দেন।
দুজনের জন্যে দু বোতল বিয়ারের অর্ডার দিয়ে, মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। মেয়েটিকে বলেছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি চমৎকার গাইতে পারেন; ইউরোপে এমন গান গাইলে আপনার কদর হত!
আপনাদের হোটেলে কোনো সুযোগ পাবার সম্ভাবনা আছে? মিস মনরো এবার জিজ্ঞাসা করলেন।
মার্কোপোলো চমকে উঠলেন, আমাকে চেনেন আপনি?
করুণ হেসে মেয়েটি বললে, ছোট জায়গায় গান গাই বলে, বড় জায়গার খবর রাখব না?
মার্কোপোলো এবার মুষড়ে পড়লেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমাদের হোটেল যারা চালান এবং সেই হোটেলে যাঁরা আনন্দ করতে আসেন, মেম্ ইন ক্যালকাটা কোনো জিনিসের সঙ্গেই তারা সম্পর্ক রাখেন না। আমাদের হোটেলে নাচবার জন্যে, গাইবার জন্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা মে ইন ইউরোপ, কিংবা মে ইন ইউ-এস-এ। এমন কি, মেম্ ইন টার্কি বা ইজিপ্ট হলেও তাদের আপত্তি নেই; কিন্তু কখনই কলকাতা নয়।
মেয়েটি গান গাইবার জন্য আবার উঠে পড়েছিল। বিয়ারের বোতল দুটো সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিল, আপনার কোয়ায়েট ডিনারের যদি কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকি, তবে তার জন্যে ক্ষমা করবেন।
মার্কোপোললা সেইদিনই তার মধ্যবিত্ত হৃদয়টি পার্ক স্ট্রিটের অখ্যাত সুশান মনরোর কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছিলেন।
পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় তাঁদের দুজনের আবার দেখা হয়েছে।
মার্কোপোলো সুশান মনরোর মনের ভিতর ঢোকবার চেষ্টা করেছেন। আপনি কোনোদিন কোনো ইস্কুলে গান শেখেননি? বলেন কী? র নেচার। নিজের খেয়ালে নেচার এমন সংগীতের কণ্ঠ সৃষ্টি করেছে? মার্কোপোলো অবাক হয়ে গিয়েছেন।
শিখব কোথা থেকে? গানের ইস্কুলে যেতে গেলে তো পয়সার দরকার হয়, সুশান বলেছিল।
মার্কোপোলো ক্রমশ সব শুনেছিলেন। প্রথমে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়, পরে সুশানের ঘরে বসে মার্কোপোলো শুনেছেন, সুশানের ভাগ্য অনেকখানি মার্কোপোলোর মতো। বাবা-মা কেউ ছিল না। এ-পি-সি-আই মানুষ করেছিল। অনাথা মেয়েকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলবার জন্যে ওঁরা কোনোরকম কার্পণ্য করেননি। সাবালিকা হয়ে সুশান নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। প্রথমে নিউ মার্কেটের কাছে এক সুইশ কনফেকশনারির দোকানে কেক বিক্রি করত। কিন্তু গানের নেশা। প্রচারের লোভ। বিনা পয়সায় রাত্রে রেস্তোরাঁয় গান গাইতেও সে প্রস্তুত।