একটা অশিক্ষিত, আধা-ভাঁড়, দরিদ্র এবং অখ্যাত ফিরিঙ্গির মুখের দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখের সিগারেট শেষ করে ভদ্রলোক। আর একটা সিগারেট ধরালেন। বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনেকটা ধোঁয়া জমে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বায়রন বললেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু জানালাটা খুলে দিলে এখনই চারপাশের বাড়ির আধপোড়া কয়লার ধোঁয়া ঢুকে অবস্থা আরও খারাপ করে তুলবে।
একটু থামলেন বায়রন। তারপর বললেন, জীবনটাই ওই রকম। নিজের দুঃখের ধোঁয়ায় কাতর হয়ে, বাইরে গিয়ে দেখেছি সেখানে আরও খারাপ অবস্থা। আমার দুঃখকে ছাপিয়ে, সে-দুঃখ জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। তুমি তো আইনপাড়ায় অনেকদিন ছিলে। জীবনকে তুমি তো শাজাহান হোটেলের রঙিন শো-কেসের মধ্য দিয়ে দেখোনি। মার্কোপোলো বেচারার ইতিহাস তোমার ভালো লাগবে।
বায়রন সায়েবের মুখে সেদিন মার্কোপোলোর কাহিনি শুনেছিলাম।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভেনিসের অভিজাত বংশীয় যে সন্তান অজানার আহ্বানে কুবলাই খানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, এ-কাহিনি আমার কাছে তার মতোই চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল।
বাইরে থেকে ওঁকে দেখলে খুবই সুখী মনে হয়, তাই না?
বায়রন সায়েব জিজ্ঞাসা করেছিলেন। দু হাজার টাকা মাইনের চাকরি।
দু হাজার টাকা! আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ। যুদ্ধের পর ইউরোপে একটা জিনিস হয়েছে, কাজের মানুষ আর বেশি বেঁচে নেই। যারা আছে, তাদের সস্তা দামে পাওয়া যায় না। বড় হোটেল ভালোভাবে চালাতে গেলে ওই মাইনেতে আজকাল ম্যানেজার পাওয়া যায় না। রেঙ্গুনে ভদ্রলোক এ ছাড়াও বিক্রির উপর কমিশন পেতেন।
কিন্তু মার্কোপোলোর জীবন চিরকাল কিছু এমন সুখের ছিল না। মিডল-ইস্টে এক গ্রিক সরাইওয়ালার ছেলে। বিদেশে বেশ কিছুদিন থেকে, সামান্য পয়সা জমিয়ে সরাইওয়ালা নবজাত শিশু এবং স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথে দুঃখের অভিজ্ঞতা প্রস্তুত হয়ে ছিল। নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তারা আরবের এক শহরে হাজির হলেন। রাত্রি কাটাবার জন্যে ওঁরা শহরের এক হোটেলে ঘরভাড়া করলেন। কিন্তু সেই হোটেলের বিল তাদের শোধ করতে হয়নি; হোটেলের ঘর থেকে তাদের আর বেরিয়েও আসতে হয়নি। সেই রাত্রেই এক সর্বনাশা ভূমিকম্পে শহরটা ধ্বংস হয়ে যায়।
দেশ-বিদেশের লোকেরা প্রকৃতির এই অভিশপ্ত শহরকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলেন। কয়েক হাজার লোক নাকি সেবার ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
ওই শহর থেকে মাইল তিরিশেক দূরে একদল ইতালীয় পাদ্রি সেই সময় কাজ করছিলেন। তাঁবু ফেলে তারা চোখের চিকিৎসা করেন। দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টিদানের জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ। দুটো রেডক্রশচিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে মালপত্তর চড়িয়ে সার্কাস পার্টির মতো তাঁরা কোনো গ্রামে এসে হাজির হন। মাঠের মধ্যে তাঁবু পড়ে। আকাশে পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। পোর্টেবল লোহার খাটগুলো জোড়া লাগিয়ে গোটা-পনেরো বিছানার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর-একটা ছোট তাঁবুর মধ্যে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে তৈরি হয় অপারেশন থিয়েটার।
স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানদের আগে থেকে খবর দেওয়া থাকে। ঢাক বাজিয়ে, পোস্টার বিলিয়ে, দূর-দূরান্তে জানিয়ে দেওয়া হয়—অন্ধজনকে আলো দেবার জন্য ফাদাররা এসে গিয়েছেন। নদীর ধারে গ্রামের তাঁবুতে তারা দিন পনেরো থাকেন, বহু রকমের সর্বনাশা চোখের রোগের চিকিৎসা করেন, প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার করেন। তারপর কাজ শেষ হলে ক্যাম্প
গুটিয়ে আবার অন্য গ্রামের দিকে রওনা হয়ে যান।
ভূমিকম্পের খবর পেয়ে ক্যাম্প থেকে ইতালীয় ফাদাররা ছুটে এলেন। ধ্বংসস্তুপ সরাতে গিয়ে তারা এক ইউরোপীয় শিশুকে আবিষ্কার করলেন। তারই অনতিদুরে শিশুর বাবা ও মার প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেল।
পিতৃমাতৃহীন শিশুকে ফাদাররা সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ইতালিতে ফিরে নিজেদের অনাথ আশ্রমে মানুষ করতে লাগলেন।
শিশুর নাম কী হবে? প্রধান পুরোহিত বললেন, এর ভ্রমণ যোগ আছে। কোথায় এর জন্ম, কোথায় একে আমরা আবিষ্কার করলাম, এবং কোথায় একে আমরা নিয়ে এলাম। এর একমাত্র নাম হতে পারে মার্কোপোলো।
ভ্রমণের ভক্ত ছিলেন বোধহয় সেই ফাদার, আর সেই সঙ্গে ইতিহাসেরও।
অন্য কেউ-ই তেমন আপত্তি করলেন না। ফলে বিংশ শতকে ইতালির ভৌগোলিক সীমানায় ভেনিসের মার্কোপোলো আবার জন্মগ্রহণ করলেন।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনাথ শিশুরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে ধর্মীয় পিতাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। মার্কোপোলোকে তারা পাঠালেন কলেজ অফ হোটেলিং-এ। এ-দেশে যার আর কিছু হয় না, সে হোমিওপ্যাথি করে, শর্টহ্যান্ড শেখে, নয় হিন্দু হোটেল খুলে বসে। ও-দেশে তা নয়। কন্টিনেন্টে লোকেরা, বিশেষ করে সুইশ এবং ইতালিয়ানরা, হোটেল ব্যবসাকে হালকাভাবে নেয়নি। হোটেল-বিজ্ঞানে পণ্ডিত হবার জন্য দেশ-বিদেশের ছাত্ররা এখানকার হোটেল-কলেজে পড়তে আসে। এই কলেজের ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি পাওয়া ছেলেদের পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে বড় বড় হোটেলে দেখতে পাওয়া যায়।
এই একটি ব্যবসা, যেখানে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। নিজেদের রাজত্ব এই কলকাতা শহরেই, দু-একটা ছাড়া সব হোটেল, এবং কনফেকশনারি দোকান কন্টিনেন্টের লোকদের হাতে ছিল। এবং যে দু-একটার মালিকানা ইংরেজদের ছিল, তাদের উপরের দিকের কর্মচারী সবই সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা ইতালি থেকে আসত।