আর এক আপিসে গিয়েছি। ওঁদের দত্ত সায়েব এক সময় বিপদে পড়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমারই অনুরোধে সায়েব বিনা ফিতে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু দত্ত সায়েব দেখা করলেন না। স্লিপ হাতে বেয়ারা ফিরে এল। সায়েব আজ বড়ই ব্যস্ত। দেখা করতে না পারার জন্য স্লিপের উপর পেন্সিলে আফসোস প্রকাশ করেছেন। এবং আগামী কয়েক সপ্তাহ যে তিনি কর্মব্যস্ত থাকবেন এবং যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার সুমধুর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবেন না, তাও জনিয়ে দিয়েছেন।
বেয়ারা বলেছিল, চিঠি লিখিয়ে। লজ্জার মাথা খেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। বলা বাহুল্য, উত্তর আসেনি।
আরও অনেক আবেদনপত্র পাঠিয়েছি। পরিচিত, অপরিচিত, বক্স নম্বর, অনেকের কাছেই আমার গুণাবলীর সুদীর্ঘ বিবরণ পেশ করে পত্র দিয়েছি। কিন্তু সরকারি পোস্টাপিসের রোজগার বৃদ্ধি ছাড়া তাতে আর কোনো সুফল হয়নি।
হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করিনি কোনোদিন। সামান্য যা পুঁজি ছিল তাও শেষ হয়ে এল। এবার নিশ্চিত উপবাস।
হা ঈশ্বর! কলকাতার হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টারের শেষ বাবুর কপালে এই লেখা ছিল?
ফেরিওয়ালার কাজ পাওয়া গেল অবশেষে। ভদ্রভাষায় নাম সেলসম্যান। ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট বিক্রি করতে হবে আপিসে। কোম্পানির নাম শুনলে শ্রদ্ধায় আপনার মাথা নত হয়ে আসবে। ভাববেন, ম্যাগপিল অ্যান্ড ক্লার্ক কোম্পানিটি বার্মাশেল, জার্ডিন হেন্ডারসন বা অ্যান্ড্রু ইউলের সমপর্যায়ের। কিন্তু এই কোম্পানির কর্ণধার এম জি পিল্লাই নামক মাদ্রাজি ছোকরার দুটো প্যান্ট ও একটা নোংরা টাই ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ছিল না। ছাতাওয়ালা লেনের এক অন্ধকার বাড়ির একখানা ঘরে তার ফ্যাক্টরি, আপিস, শো রুম, মায় শোয়ার এবং রান্নার ঘর। এম জি পিল্লাই ম্যাগপিল হয়েছেন। আর ক্লার্ক সায়েব? উনি কেউ নন, ম্যাগপিলের ক্লার্ক!
তারের পাকানো ঝুড়িগুলো আমাকে বিক্রি করতে হবে। টাকায় চার আনা কমিশন। প্রতি ঝুড়িতে চার আনা। সে যেন আমার কাছে স্বর্গ।
কিন্তু তাও বিক্রি হয়নি। ঝুড়ি হাতে আপিসে আপিসে ঘুরেছি, আর বাবুদের টেবিলের তলায় তাকিয়েছি। অনেকে সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওখানে কী দেখছো?
বলেছি, আজ্ঞে, আপনার ছেঁড়া-কাগজ ফেলবার ঝুড়িটা।
সেটা জরাজীর্ণ দেখলে কি আনন্দই যে হয়েছে। বলেছি, আপনার ঝুড়িটার আর কিছুই নেই। একটা নতুন নিন না, স্যর। খুব ভালো জিনিস। একটা কিনলে দশ বছর নিশ্চিন্ত।
বড়বাবু ঝুড়িটার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছেন, কন্ডিশন তো বেশ ভালোই রয়েছে। এখনও হেসে-খেলে বছরখানেক চলে যাবে।
বড়বাবুর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থেকেছি। কিন্তু আমার মনের কথা তিনি বুঝতে পারেননি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ঝুড়িটার
হয় হেসে-খেলে আরও বছরখানেক চলে যাবে। কিন্তু আমার? আমার যে আর একদিনও চলতে চাইছে না।
কিন্তু বলার ইচ্ছে থাকলেই চার্নক সায়েবের এই আজব শহরে সব কিছু বলা যায় না। তাই নীরবে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।
স্যুট-পরা, টাই-বাঁধা বাঙালি সায়েবদের সঙ্গেও দেখা করেছি। জুতোর ডগাটা নাড়তে নাড়তে সায়েব বলছেন, ভেরি গুড। ইয়ং বেঙ্গলিরা যে বিজনেস লাইনে এন্টার করছে এটা খুবই আশার কথা।
বলেছি, আপনাকে তাহলে কটা দেব, স্যর?
স্যর আমার দিকে তাকিয়ে একটুও দ্বিধা না করে বলেছেন, আমার ছটা দরকার। কিন্তু দেখবেন আমাদের শেয়ারের কথাটা যেন ভুলে যাবেন না।
ছটা ঝুড়ি বিক্রি করে আমার দেড় টাকা লাভ। বিক্রির টাকা পেয়ে, সেই দেড় টাকা হতে নিয়ে বলেছি, ছটা ঝুড়িতে আমার এই থাকে স্যর। আপনার যা বিচার হয় নিন।
সিগারেট টানতে টানতে সায়েব বলেছেন, অন্য কারুর কাছে পারচেজ করলে ইজিলি থার্টি পারসেন্ট পেতাম। তা হাজার হোক আপনি বেঙ্গলি, সুতরাং টোয়েন্টিফাইভই নিলাম। এই বলে পুরো দেড়টা টাকাই আমার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছেন। তারপর দুঃখ করেছেন, আমাদের জাতের অনেষ্টি বলে কিছু নেই। এর মধ্যেই বেশ এক্সপার্ট হয়ে উঠেছেন তো। কী করে বললেন যে ছটা ঝুড়িতে আপনার দেড় টাকার বেশি থাকবে না? আমরা কি grass-এ মুখ দিয়ে চরি?
কোনো উত্তর না দিয়েই সেদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। অবাক হয়ে এই অদ্ভুত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি।
আশ্চর্য। এই পৃথিবীকেই একদিন কত সুন্দর বলে মনে হয়েছিল আমার। এই পৃথিবীতেই আমি একদিন মানুষকে শ্রদ্ধা করতাম। বিশ্বাস করতাম, মানুষের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করেন। হঠাৎ মনে হল, আমি একটি গর্দভ। সংসারের সংখ্যাহীন আঘাতেও আমার শিক্ষা হয়নি। আমার জ্ঞান-চক্ষু কি কোনোদিন উন্মীলিত হবে না? না না, অসম্ভব। আমাকে চালাক হয়ে উঠতেই হবে।
সত্যিই আমি চালাক হয়ে উঠলাম। এক টাকার ঝুড়ির দাম বাড়িয়ে পাঁচ-সিকে বলেছি। যিনি কিনলেন তাকে বিনা দ্বিধায় চার আনা পয়সা দিয়ে বলেছি, কিছুই থাকে না, স্যর। যা কম্পিটিশনের মার্কেট। টিকে থাকার জন্যে উইদাউট মার্জিনেই বিজনেস করছি।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি বটে, কিন্তু তাতে কোনো কষ্ট হয়নি আমার। শুধু মনে হয়েছে, স্বার্থান্ধ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি একা। আমাকে নিজের বুদ্ধি দিয়ে, চালাকি করে বেঁচে থাকতে হবে, পথ তৈরি করতে হবে, এবং এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের কোনো আনন্দের আয়োজনে আমরা নিমন্ত্রিত অতিথির সমাদর পাব না, সুতরাং প্রয়োজন মতো জোর করেই ভাগ বসাতে হবে।