প্লাসটিকের অক্ষর দিয়ে দরজার সামনে বোধহয় নাম লেখা ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ অক্ষর কোন সময়ে বন্ধনমুক্ত হয়ে দরজা থেকে বিদায় নিয়েছে, শুধু R O N অক্ষরগুলো মালিকের মায়া কাটাতে না পেরে, কোনোরকমে ভাঙা আসর জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
দরজায় বেল ছিল। কয়েকবার টেপার পরও কোনো উত্তর না-পেয়ে বুঝলাম, ওই যন্ত্রটির শরীরও সুস্থ নয়। তখন আদি ও অকৃত্রিম ভারতীয় পদ্ধতিতে ধাক্কা মারা শুরু করলাম। এবার ফল হল। ভিতর থেকে এক শৃঙ্খলবদ্ধ কুকুরের স্বাধীনতার-দাবি-জানানো স্লোগান শুনতে পেলাম। দরজা খোলার শব্দ হল; এবং পরের মুহূর্তেই যিনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি খোদ বায়রন সায়েব।
চোখ মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, আরে, কী ব্যাপার?
প্রচুর আদর করে তিনি আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। এই ভরসন্ধ্যাবেলায় উনি কি ঘুমোচ্ছিলেন?
একটা ছেঁড়া বেতের চেয়ারে বসতে বলে বায়রন সায়েব চোখে মুখে জল দেবার জন্য বাথরুমে গেলেন। দেখলাম, টেবিলের উপর এক কাড়ি পুরনো আমেরিকান ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন ছড়ানো রয়েছে। দেওয়ালের কোণে কোণে ঝুল এবং নোংরা জড়ো হয়ে আছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা ময়লা তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বায়রন বললেন, খুব অবাক হয়ে গিয়েছ, তাই না? ভাবছ লোকটা এখন ঘুমোচ্ছিল কেন? তার উত্তর দিচ্ছি। কিন্তু ফার্স্ট থিং ফাস্ট। আগে একটু চা তৈরি করি।
বললাম, এইমাত্র খোদ মার্কোপোলোর সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি।
মার্কোপোলোর সঙ্গে বসে তুমি সেন্ট পারসেন্ট পিওর আগমার্কা অমৃত খেলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে একটু চা খাবে না, তা কি হয়? তোমার এখনও বিয়াল্লিশ কাপ চা পাওনা।
বায়রন সায়েব নিজেই চা-এর ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলেন। বললেন, আমার স্ত্রী আজ ফিরবেন না। আপিস থেকে সোজা বাটানগরে এক বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে যাবেন।
হিটারে কেটলি চাপিয়ে বায়রন বললেন, যা বলছিলাম, আমাকে ঘুমোতে দেখে তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গিয়েছ। কিন্তু এটা জেনে রাখো, আমরা ডিটেটিভরা যা করি তার প্রত্যেকটারই পিছনে একটা গোপন উদ্দেশ্য থাকে।
তা তো বটেই, আমি সায় দিলাম।
হ্যাঁ, বায়রন সায়েব বললেন। আমার স্ত্রীকেও সবসময় ওই কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু তুমি যেমন সহজেই আমার স্টেটমেন্ট মেনে নিলে, তিনি তা করবেন না। তিনি তখন হাজারটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন। অথচ, সবসময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। গোপনীয়তাটাই আমাদের ব্যবসা। আমাদের প্রফেশনে এমন অনেক কথা আছে, যা নিজের স্ত্রীকেও বলা সেফ নয়। হাজার হোক আমরা ইন্ডিয়াতে বাস করছি। দেওয়ালের কান যদি কোথাও থাকে সে এই দেশেতেই,—পার্টিকুলারলি এই ক্যালকাটাতেই আছে।
বললাম, আপনার তাহলে বেশ কষ্ট হয়।
বায়রন সায়েব ঘাড় নাড়লেন। সেই জন্যই আমাদের ডিটেকটিভ ওয়ার্লডে একটা মতবাদ আছে, ডিটেকটিভদের বিয়ে করাই উচিত নয়।
অ্যাঁ! নতুন থিওরির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম।
বায়রন সায়েব বললেন, এতে চমকাবার কিছু নেই। পাদ্রিরা বিয়ে করবে, না চিরকুমার থাকবে এই নিয়ে চার্চে যেমন অনেকদিন মতদ্বৈধ ছিল, এটাও তেমনি। চিরকুমার স্কুল অফ ডিটেকটিভরা বলছেন, এই পেশার পক্ষে ওয়াইফরা পজিটিভ নুইসেন্স।
হাইকোর্টের অনেক বড় বড় ব্যারিস্টারও গোপনে এ মত পোষণ করেন, আমি বললাম।
করতে বাধ্য। প্রত্যেকটি উচ্চাভিলাষী অথচ বুদ্ধিমান লোক ওই কথা বলবেন।
হিটার থেকে কেটলিটা নামিয়ে বায়রন সায়েব বললেন, তবে কি জানো, আমার ওয়াইফকে আমি দোষ দিতে পারি না। সাসপিশন অর্থাৎ সন্দেহটাও আমাদের পেশার প্রথম কথা—শেষ কথাও বটে। আমার সেই গুণ আছে, অথচ আমার ওয়াইফের সন্দেহবাতিক থাকবে না, সেটাও ভালো কথা নয়। হাজার হোক, একটা ব্রেন সবসময় নিখুঁত কাজ করতে পারে না, ডবল ইঞ্জিন থাকলে বিপদের আশঙ্কা কম।
আমি চুপচাপ তাঁর কথা শুনছিলাম। গরম চা এক কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, যা বলছিলাম, কেন এই অসময়ে ঘুমোচ্ছিলাম জানো? আজ রাত্রে আমার হয়তো একটুও ঘুম হবে না। সারারাত আমাকে একজনকে খুঁজে বেড়াতে হবে। কাকে খুঁজে বেড়াব, তার নাম হয়তো তোমার জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন নয়, পরে বলব। এই সিক্রেটটা গভর্নমেন্টের বাজেটের মতো; যতক্ষণ না পার্লামেন্টে অ্যানাউন্স করছি ততক্ষণ টপ সিক্রেট, কিন্তু তারপরই জনসাধারণের প্রপার্টি।
বায়রন সায়েব এবার আমার খোঁজ নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, খবর কী? কাজকর্ম ঠিক চলছে তো?
বললাম, আজ্ঞে, হ্যাঁ। মেয়েটা এখনও ফেরেনি।
হুঁ, রোজির খবরটা তো নেওয়া হয়নি। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত আছি। মেয়েটা ফিরবে কি না, খবরটা নিতেই হচ্ছে এবার। মিসেস ব্যানার্জিও খুব উতলা হয়ে পড়েছেন। দুদিন ওঁর মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
বায়রন সায়েব এতক্ষণে ম্যানেজারের খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে বলতে হল, তার জন্যই এই সন্ধ্যাবেলায় আমি এখানে এসেছি।
কিছু বলেছেন তিনি? বায়রন প্রশ্ন করলেন।
মার্কোপোলো খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, এ কথাটাই আপনাকে জানাতে বলেছেন।
বায়রন এবার বেশ গম্ভীর হয়ে উঠলেন। চা-এর কাপটা পাশে সরিয়ে দিয়ে, পকেট থেকে একটা সস্তা দামের সিগারেট বার করে ধরালেন। বললেন, বাবু, বড় ডাক্তার হওয়ার বাধা কী জানো? ইউ মাস্ট নট ফিল টু মাচ ফর দি পেসেন্ট-রোগী সম্বন্ধে তুমি খুব বেশি অভিভূত হবে না। আমাদেরও তাই। বিপদে পড়ে এসেছ। তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে চেষ্টা করলাম, এই পর্যন্ত। পারলাম ভালো, না পারলে বেটার লাক নেস্ট টাইম। কিন্তু পারি না। জানো, চেষ্টা করেও পারি না। বেচারা মার্কোপোলো। ওর জন্যে সত্যিই আমার দুঃখ হয়।