ওঁর সবল দুই হাত দিয়ে রাম সিংকে ঘরের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়বেন। তখন সাবধানে ওঁর ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে হবে। অতি সন্তর্পণে ওঁর বুক পর্যন্ত চাদরে ঢেকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘণ্টাখানেক পরে মথুরা সিংকে আবার আসতে হবে। এবার আলোটা জ্বেলে ঘরের মেঝেটা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। কারণ ভোরবেলায় সায়েব যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন কিছুই মনে থাকবে না। হয়তো সারা ঘরময় ছড়ানো ভাঙা কাচের টুকরোয় নিজের পা কেটে বসবেন।
সেবার ওই রকম হয়েছিল। রাত্রে তাঁর ঘরে কেউ ঢুকতে সাহস করেনি। আর ভোরবেলায় ওঁর পা কেটে গেল। মথুরাকে ডেকে সায়েব বললেন, মাতাল হয়েছিলাম বলে, তোমরা আমাকে এইভাবে শাস্তি দিলে? তোমরা কেউ কি আমাকে ভালোবাসো না?
সেই থেকে মথুরা গণ্ডগোলের রাত্রে ঘুমোয় না। সায়েবের ঘরের বাইরে, একটা টুলের উপর সারারাত জেগে বসে থাকে। আর মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকায়, কখন এই অসহ্য রাত্রির শেষে, সর্বপাপঘ্ন সূর্যের উদয় হবে। অশিষ্ট, অপ্রকৃতিস্থ পৃথিবী আবার দিনের আলোয় শান্ত হবে; নিজের জ্ঞান ফিরে পাবে।
রাত্রের এই নাটকের কাহিনি আমি মথুরার কাছেই শুনেছি। কিন্তু পরের দিন ব্রেকফাস্টের পর ম্যানেজারকে দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। পরিশ্রমের অফুরন্ত উৎস যেন ওঁর শরীরের মধ্যে রয়েছে; দেহের উপর অত অত্যাচারের পরও পশুর মতো খাটতে দেখেছি তাকে।
মার্কোপোলো যেন আমাকে একটু সুনজরে দেখতে শুরু করেছেন। অন্যলোকের কাছে গম্ভীর হয়ে থাকলেও, আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এক একদিন কাজের শেষে বলেছেন, এখনও বসে রয়েছ কেন? তুমি কি সাধু বনে গিয়েছ?
বলতাম, কই না তো?
তা হলে, এখনও এই হোটেলের বদ্ধ ঘরে বসে রয়েছ কেন? কলকাতা শহরে কত ফুর্তি পাখি হয়ে এখন উড়ে বেড়াচ্ছে। যাও, তার দু একটা ধরে উপভোগ করে নাও।
বায়রন সায়েবের খোজ পড়ল একদিন। সেই যে এক রাত্রে বায়রন সায়েব হোটেলে আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন, তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। আমার উপকার করবার জন্যই স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার মর্মর মূর্তির সামনে আবির্ভূত হয়ে, তিনি যেন আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করলেন, বায়রনের সঙ্গে দেখা হয় তোমার?
বলতে হল, না।
সেই রাত্রের পর তোমার সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি? উনিও দেখা করতে আসেননি, আর তুমিও যাওনি?
আজ্ঞে না।
মার্কোপোলো বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নিজের হাতঘড়িটার দিকে একবার নজর দিলেন। তারপর জানলা দিয়ে বাইরের একটুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, কিন্তু সন্ধ্যা হতেও বেশি দেরি নেই।
এবার তিনি যা বললেন, তা শোনবার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম। মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে, চোখ দুটো ছোট করে বললেন, তুমি অত্যন্ত ক্লেভার। অনেক জেনেও তুমি মুখটাকে ইনোসেন্ট রাখতে পেরেছ।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তার কথাতে একটু রহস্যের গন্ধ পেলাম। তিনি হয়তো সন্দেহ করছেন, আমি কিছু সংবাদ জানি, অথচ বলছি না। বললাম, আপনার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যর।
মার্কোপোলো এবার লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন, না না, তুমি রাগ কোরো না, এমনি মজা করছিলাম।
হঠাৎ কথা বন্ধ করে মার্কোপোলো এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওঁর ওই বিশাল চোখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস বা শক্তি আমার ছিল না। তাই চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। একটু পরে আবার ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল, বড়ো করুণভাবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
ধীরে ধীরে মার্কোপোলো বললেন, আমার একটা উপকার করবে? বায়রনের সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে? প্লিজ।
বলতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলতে হবে? না, কিছুই বলতে হবে না। যদি ওঁর সঙ্গে দেখা হয়, ওঁকে জানিও, আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছি।
তখনই বেরোতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সায়েব বাধা দিলেন। বললেন, ইয়ংম্যান, চা-এর সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই চা আসবে। আগে চা খাও।
মার্কোপোলো বেল টিপলেন। হোটেলের ঘড়ির কাঁটা তখন চায়ের ঘরেই হাজির হয়েছে। দুশো, আড়াইশো ঘরে একই সঙ্গে চা পৌঁছে দিতে হবে। বেয়ারারা এতক্ষণে প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে, চাপা গলায় বলছে—জলদি, জলদি।
বেলের উত্তরে বেয়ারা এসে হাজির হল না। সে নিশ্চয় ততক্ষণ প্যান্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দুজন লোক দ্রুতবেগে কেটলির মধ্যে গরম জল ঢালছে। আর একজন লোক যন্ত্রের মতো প্রতি কেটলিতে চা ঢেলে যাচ্ছে। বেয়ারারা ইতিমধ্যেই ফ্রিজ থেকে দুধ এবং আলমারি থেকে চিনি বার করে নিয়েছে। এত কেটলি এবং ডিস কাপ যে একসঙ্গে হাজির হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
ম্যানেজার সায়েবের ঘরে চা আসতে দেরি হল না। কেটলির টোপর খুলে দিয়ে মথুরা সিং সেলাম করে দাঁড়াল। এই সেলামের জিজ্ঞাসা, সায়েব নিজের খুশিমতো চা তৈরি করবেন, না সে দায়িত্ব মথুরার উপর অর্পণ করবেন।
মার্কোপোলো মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক হ্যায়। মথুরা সিং আর একটা সেলাম দিয়ে বিদায় নিল।
অভ্যস্ত হাতে কেটলির ভিতরটা চামচে দিয়ে নেড়ে নিয়েই ম্যানেজার সায়েব আঁতকে উঠলেন। বললেন, খারাপ কোয়ালিটির চা।
মথুরার ডাক পড়ল। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বললে, না হুজুর, সকালে যে চা খেয়েছেন, সেই একই চা।