আমার এতদিনের পরিচিত কাউন্টারটাও আমাকে বুঝল না। সেও হাসছে, বলছে, লজ্জা করে না—কোথাকার কোন একটা মেয়ে প্রেমে মাতাল অবস্থায় কাকে কী বললে, আর গাধা তুমি সেইটা বিশ্বাস করলে।
মধ্যরাতের সেন্ট্রাল অ্যাভি, ধর্মতলা স্ট্রিট, চৌরঙ্গী রোড সবাই গভীর ঘুমে অচৈতন্য। শুধু শাজাহানের নিয়ন আলো একজন বরখাস্ত কর্মচারীকে ব্যঙ্গ করবার জন্যেই যেন নিভেছে আর জ্বলছে।
এখন আমার কিছু হারাবার ভয় নেই। আমার যা ছিল সবই বিসর্জন দিয়েছি। তবু লজ্জার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছি না। অনেকদিন আগে ক্লাইভ বিল্ডিংয়ের একটা অশিক্ষিত দারোয়ান এইভাবে আমাকে লজ্জায় ফেলেছিল। আর আজ সমস্ত স্থাবর কলকাতা সুযোগ পেয়ে আমাকে ব্যঙ্গ করছে-ওই চলেছেন, ওই তোমাদের একসেপশনাল পার্সন চলেছেন।
সেন্ট্রাল অ্যাভিন, চৌরঙ্গী, পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে পাগলের মতো হাঁটতে হাঁটতে থিয়েটার রোডের মোড়ে কখন হাজির হয়েছি খেয়াল করিনি। ইলেকট্রিক আলোর পোস্টগুলোও পথের ধারে আমাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি।
এখন যেখানে বিড়লা প্লানেটরিয়াম, সীমাহীন আকাশের সংখ্যাহীন জ্যোতিষ্কের সংবাদ যেখানে রয়েছে, ঠিক সেইখানেই আমি সাধারণ চোখেই আকাশের তারাদের সঙ্গে সেদিন সংযোগ স্থাপন করেছিলাম। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে যাবার পথে বিশাল বনস্পতি দল আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল। ওরা বলেছিল, আমরা জানিনা, হয়তো তুমি অসাধারণ, কে জানে! গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সুদূর আকাশের তারারাও যেন সেই মতে সায় দিয়েছিল—আমরা হাসব না, আমরা ব্যঙ্গ করব না। কে জানে কোথায় কী আছে—আমরা শুধু নীরবে দেখে যাব।
আগামী যুগে প্ল্যানেটরিয়ামের কোনো কল্পনাপ্রবণ দর্শক সীমাহীন গগনের ইশারা থেকে কোনো নবজীবনের ইঙ্গিত পাবেন কি না জানি না। কিন্তু সেই জনহীন রাত্রে দুর আকাশের তারারা আমাকে নতুন জীবনের আশ্বাস দিয়েছিল। বিস্ময়ভরা এই ভুবনে সেই মুহূর্তে আমি যেন নতুন করে জন্মগ্রহণ করলাম। সেই মুহূর্ত থেকেই এই পৃথিবীকে, এই শাজাহান হোটেলকে যেন অন্যরূপে দেখতে শুরু করলাম।
সুজাতাদি, করবী গুহ, কনি, গোমেজ, সত্যসুন্দর বোস, কারুর জন্যেই আমি আর বিধাতার আদালতে অভিযোগ করব না। আমি কেবল নিজেকে প্রকাশ করব। যে অসংখ্য প্রাণ আমাদেরই মতো নানা দুঃখে জর্জরিত, তাদের সঙ্গে নিজের দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেব।
শান্ত মনে আবার চৌরঙ্গী পেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর পথে এসে দাঁড়িয়েছি। দূরে নিয়ন-শোভিত শাজাহানের ক্লান্তিহীন ত্রিনয়ন তখনও জ্বলছে আর নিভছে।
শেষবারের মতো সেই আশ্চর্য জগতের দিকে তাকিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতিতে আমার মন ভরে উঠল। অনেকদিন আগের এক পুরনো ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমাদের এই কলকাতা দেখতে এসে ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং আর এক প্রাচীন হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ভয়াবহ শহরের ভয়াবহ রাত্রির সঙ্গে পরিচিত হয়ে, গভীর রাত্রে হোটেলে ফেরবার পথে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তারই কাছাকাছি কোথাও তিনিও থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের উদ্ধত কবি এইখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন : Al good Calcutta has gone to bed, the last tram has passed, and the peace of the night is upon the world, Would it be wise and rational to climb the spire of that kirk and shout : O true believers? Decency is a fraud and sham. There is nothing clean or pure or wholesome under the stars, and we are all going to perdition together. Amen!
মধ্যরাতের কলকাতায় দাঁড়িয়ে কর্মহীন, আশ্রয়হীন আমিও হয়তো সেই একই সর্বনাশের প্রার্থনা করতাম। কিন্তু অনেক অভিযোগ ও বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই তা পারলাম না।
সর্বনাশ, অধঃপতন ও ধ্বংসের চিন্তায় পুলকিত পাশ্চাত্যের গর্বিত কবি পরম ঘৃণায় বলেছিলেন, আমেন—তাই হোক। কিন্তু আকাশের অগণিত নক্ষত্র আমাকে আশা দিল, বল দিল। আমি বুঝলাম, আমাদের সামনে উদার অনন্ত সময় রয়েছে। মঙ্গলের স্পর্শে আমাদের এই পাপপঙ্কিল নগরীও একদিন নিশ্চয় পবিত্র হয়ে উঠবে।
শেষবারের মতো পিছন ফিরে আমার প্রিয় পান্থশালার দিকে তাকালাম। শাজাহানের ক্লান্তিহীন লাল আলো তখনও জ্বলছে আর নিভছে।
আমি এগিয়ে চললাম।