হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও শুনতাম। কিন্তু বেয়ারা এসে আমাকে ডাকল—জিমি সায়েব সেলাম দিয়েছে।
কাউন্টারে রোজি এবং আমাদের নতুন মহিলা রিসেপশনিস্ট দাঁড়িয়েছিলেন। নতুন মহিলাটি ছোট্ট আয়নার সামনে প্রসাধনের ফিনিশিং টাচ দিতে ব্যস্ত ছিলেন। আর রোজি আপন মনে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল। আমাকে দেখেই রোজি চমকে উঠল। আমার দিকে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।কিছু বলবে? আমার প্রশ্নে রোজি আরও ভয় পেয়ে গেল। সে আবার আমার দিকে তাকাল।
জিমির ঘরে মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জিও বসেছিলেন। জিমি বললে, আই অ্যাম স্যরি, তোমাকে এই সময় ডেকে পাঠালাম। কিন্তু মিস্টার চ্যাটার্জি এখনই ক্যাবারেতে গিয়ে বসবেন। ওঁকে ওইসব খুঁটিয়ে স্টাডি করতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ মাসের শেষ তারিখ। তোমার এবং আমাদের পক্ষেও সুবিধে। তোমাকে কাল থেকে আমাদের প্রয়োজন নেই।
পাইপটা মুখ থেকে বের করে ফোকলা বললেন, দাড়িগোঁফওয়ালা পুরুষদের দিয়ে রিসেপশনে যে কাজ চলে না, তা তুমি নিজেও বুঝতে পারছ নিশ্চয়। উইশইউ সাকসেস ইন লাইফ।জীবনে উন্নতি করো এই প্রার্থনা। ফাইলে দেখলাম মার্কো তোমাকে পিওরলি টেম্পরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন। দ্যাট মিনস এক মাসের মাইনেতেও তুমি এনটাইটল্ড নও। কিন্তু নিউ ম্যানেজমেন্ট পুরনো দিনের শোষণে বিশ্বাস করেন না। তারা সোসালিস্ট সোসাইটি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে চান। সেই জন্যে তোমাকে এক মাসের এক্সট্রা মাইনে দেওয়া হচ্ছে।
জিমি আমার দিকে একটা নোট ভর্তি খাম এগিয়ে দিলেন। আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দেবার জন্যই ফোকলা বললেন, গুড় নাইট।
আমার পৃথিবীটা দুলতে আরম্ভ করেছে। ছাদে উঠে দেখলাম রোজি আমারই জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার কাছে এসে সে বললে, আই অ্যাম স্যরি। বিশ্বাস করো, আমি চিঠি টাইপ করবার সময় জিমিকে বারণ করেছিলাম।ওর হাত চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু জিমি মিস্টার চ্যাটার্জিকে আগে থেকেই বুঝিয়ে রেখেছে। কাউন্টারে ওরা মেয়ে রাখবে।
আকাশে তারা উঠেছে। সেই তারার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি আর কী করবে রোজি? তোমায় ধন্যবাদ।
কিন্তু আমার দুঃখের সেই যেন শুরু। আরও সংবাদ যে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা বুঝিনি। গুড়বেড়িয়া তখনও কিছু জানতে পারেনি। গুড়বেড়িয়া বললে, বাবুজি, আপনার একটা চিঠি এসেছে।
সত্যসুন্দরদার চিঠিটা সম্পূর্ণ পড়বার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। হাত থেকে ফসকে চিঠিটা মেঝেয় পড়ে গিয়েছিল। গুড়বেড়িয়া আমার সামনেই দাঁড়িয়ে থেকে ছিল। সে চিঠিটা তুলে আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললে, কী হয়েছে, বাবুজী?
সংসারে এই হয়। আমি যাদের ভালোবাসি, যারা আমায় ভালোবাসে তাদের কোনোদিন সুখী হতে দেখলাম না। সত্যসুন্দরদা লিখেছেন
প্রিয় শংকর,
আর কাকে লিখব? আর কাকেই বা আমার লিখবার আছে? তোমার সুজাতাদির চিতাভস্ম আরবসাগরের জলে বিসর্জন দিয়ে এইমাত্র ফিরে এলাম। গতকাল গভীর রাত্রে টেলিফোনে আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল দিল্লির হোটেল থেকে উইলংডন বিমানবন্দরে যাবার পথে এক ভয়াবহ মোটর দুর্ঘটনায় এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্র শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বিমান কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী নেকস্ট অফ কিনদের যে তালিকা থাকে, সুজাতা মিত্রের নামের পাশে সেখানে আমারই নাম লেখা ছিল।
পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে সুজাতার কাছে আমি সবচেয়ে প্রিয় হলাম। হাওয়াই কর্তৃপক্ষ সৌজন্যের কার্পণ্য করেননি। সুজাতার শেষ ইচ্ছামতো তার মৃতদেহও বিশেষ বিমানে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
সব স্মৃতিকে এখন দীর্ঘস্থায়ী এক স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। নিজের চাকরি এবং স্বার্থের কথা ভেবে, বিয়েটা আমি পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে আপন বলে স্বীকার করতে কোনো দ্বিধাই করেনি। শুনলাম, সুজাতার অফিসে ক্ষতিপূরণের টাকাও আমাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সর্বদা দাঁড়িয়ে থেকে জীবনকে সে অনেকে সহজভাবে নিতে পেরেছিল। আমার মতো স্বার্থের দ্বন্দে নিজেকে ছোট মনে করেনি।
এমন আমাকে বড়লোক বলতে পারো। কিন্তু রাজপুত্র আবার বোপর ছেলেতে রূপান্তরিত হল। এখানে একলা টিকে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শাজাহানে ফেরবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে উপায় নেই। তাই আফ্রিকার স্বর্ণ। উপকূলে মার্কো যে হোটেল গড়ে তুলছেন সেখানেই যাবার সংকল্প করেছি।
আগে বলিনি, আজ তোমাকে জানিয়ে যাই, হয়তো কোনোদিনই না হলে সে সুযোগ পাব না। সুজাতা তোমার সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করত। সে বলেছিল, দেখে নিও, he is an exceptional person।
একসেপশনাল! অসাধারণই বটে। শাজাহানের ছাদের ঘরগুলো একসঙ্গে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। সত্যসুন্দরদার চিঠিটা আমি পকেটে পুরে ফেলেছিলাম। কিন্তু মনে হল ওরা সবাই জেনে ফেলেছে। সুজাতাদির ঔদ্ধত্য এবং আমার দুঃসাহস দেখে ওরা হেসে গড়িয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
রাত অনেক হয়েছে। কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটা ইট যেন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে—শাজাহান থেকে চাকরি যাওয়া এই একসেপশনাল লোকটিকে তোমরা চিনে রাখো। পাগলের মতো আমি নিচেয় নামতে শুরু করেছি।
রাতের অন্ধকারে, ক্যাবারে উৎসবের শেষে, শাজাহান ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শাজাহানের টেবিল, চেয়ার, সিঁড়ি সবাই যেন আমাকে দেখে হাসি চেপে রাখবার চেষ্টা করছে।