মার্কোপোলোর বিদায়ের পর জিমি এবার নিজমূর্তি ধারণ করছে। জিমি বলছে, পুরনো কায়দায় আর হোটেল চলবে না। খোল নলচে দুই পাল্টে হোটেলকে নতুন করে তুলতে হবে। সত্যসুন্দরদার জায়গায় আধুনিক পদ্ধতিতে তাই একজন রুজলিপস্টিক-চর্চিতা যুবতী মহিলাকে আমদানি করেছেন।
ওই পোস্টে রোজির বসবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জিমি সোজা বলে দিয়েছে, তোমার ওই ছিরিতে হোটেলের প্রধান রিসেপশনিস্ট হওয়া যায় না। কাউন্টারে উইলিয়ম ঘোষ এবং আমি কেবল টিমটিম করে জ্বলছিউইলিয়মকে অবশ্য জিমি এখন বেশির ভাগ সময় অ্যাকাউন্টের কাজে লাগাচ্ছে। টাকা-কড়ি জমা নেওয়া, চেক ভাঙানো এই সবই তাকে বেশি করতে হয়।
এরই মধ্যে উইলিয়মের কাছে শুনলাম, মিস্টার আগরওয়ালা হোটেলের কন্ট্রোলিং শেয়ার বিলেতের অংশীদারদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। মিস্টার আগরওয়ালার কথা উঠলেই জিমি যেভাবে বিনয়ে বিগলিত হয়ে পড়ছিল তার থেকেই ব্যাপারটা বোধহয় আমাদের আন্দাজ করা উচিত ছিল।
উইলিয়ম বলেছিল, আপনার ভালো হলো। মিস্টার ফোকলা চ্যাটার্জিই সব দেখাশোনা করবেন। আপনার সঙ্গে তো ওঁর খুব জানাশোনা।
ফোকলা চ্যাটার্জি একদিন হোটেল দেখতে এলেন। জিমিকে প্রচুর আদর করে বললেন, আমরা কিন্তু ইউরোপিয়ান ম্যানেজমেন্টই রাখতে চাই। তবু সবকিছু যেন মডার্ন হয়—সিম্পসন সায়েবের ধাঁচে আজকাল হোটেল চলে না। তখন মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে অন্তঃপুরে বসে থাকত। এখন তারা রাস্তায় বেরিয়েছে। জিমি গদগদ হয়ে বলেছে, যা বলেছেন, মিস্টার চ্যাটার্জি। পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফোকলা বলেছেন, আমাদের মধ্যে কোনো সঙ্কীর্ণতা পাবেন না। আপনার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে আমরা নাক গলাতেও আসব না। মিস্টার আগরওয়ালা চান, এবং আমিও চাই, আপনি অ্যাট্রাকটিভ গালর্স নিয়ে আসুন—সর্ব জাতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠুক এই শাজাহান হোটেল।
অনেক অজানা মুখেই হোটেলটা ক্রমশ ভরে উঠছে। এখন সব-কিছুই গোপনে হয়। ফোকলা চ্যাটার্জি আমাকে দেখেও দেখতে পান না। মাঝে মাঝে সত্যসুন্দরদা, বায়রন এবং মার্কোপোলো সায়েবের কথা মনে পড়ে। তারা পাশে থাকলে আজ এতখানি অসহায় বোধ করতাম না।
কিন্তু পৃথিবীতে কে কাকে চিরদিন দেখতে পারে? গোমেজ বলেন, একমাত্র অলমাইটি ছাড়া কারুর উপরেই তুমি চিরদিনের জন্যে নির্ভর করতে পার না।
নিজের ঘরে আলো না জ্বালিয়ে গোমেজ নিঃশব্দে বসেছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, এতদিনে বোধহয় আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। ঈশ্বর ছাড়া কারুরই জন্যে আমরা সঙ্গীতের অর্ঘ্য নিবেদন করতে পারি না। উই শুড্ ওনলি সার্ভ আওয়ার গড্।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোমেজ বললেন,শাজাহানে আজ আমার শেষ কনসার্ট।
আমি চমকে উঠেছিলাম। গোমেজ বললেন, এরা আমাকে আর পছন্দ করছে না। সাফিসিয়েন্টলি চিয়ারফুল মিউজিক আমার যন্ত্র থেকে বেরিয়ে শাজাহানের হত্ ঘরকে প্রতিদিন যৌবনের রংয়ে রাঙিয়ে তুলতে পারছে না। জিমি এবং চ্যাটার্জি বলেছেন, আই মাস্ট গিভ দেম চিয়ারফুল মিউজিক অর কুইট।
আই মাস্ট কুইট। সাচ ইজ মাই মাস্টারস্ উইল। সেদিন ব্যান্ডেল চার্চে এক তীর্থযাত্রী ফাদারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রতীরে একটা ছোট্ট চার্চের মিউজিকের দায়িত্ব আমার উপর দিতে চান। ঈশ্বরের সেই আশীর্বাদ আমি মাথায় তুলে নিয়েছি।
আমার চোখে জল আসছিল। কিন্তু গোমেজ এবার উঠে পড়লেন। আজ শেষ রজনী। আই মাস্ট গেট রেডি মাই লাস্ট কনসার্ট। আই ডোন্ট নো হোয়াই, কিন্তু বার বার আমার লন্ডনের সেই অন্ধকার রাত্রের শেপার লাস্ট কনসার্টের কথা মনে পড়ছে।
গোমেজ আজ তার ওয়ারড্রোবের সেরা স্যুটটি পরেছেন। তার ছেলেদের জামাকাপড়ের ইস্ত্রিতেও একটু খুঁত নেই। হাতির দাঁতের বাঁধানো ছোট্ট ছড়িটাও আগের থেকে অনেক বিশ্বাসের সঙ্গে ধরেছেন।
ক্যাবারে শুরু হতে তখনও দেরি রয়েছে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, সমাগত অতিথিদের নমস্কার জানিয়ে গোমেজ বললেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আই উইল নাও ট্রিট ইউ টু সাম চিয়ারফুল মিউজিক।
সঙ্গীত শুরু হল। এ কি সেই প্রতাপচন্দ্র গোমেজ, যাঁকে এতদিন ধরে আমি শাজাহানে দেখে আসছি? এমন রক্ত-আগুন-করা চটুল সুর শাজাহানের এই ঐতিহাসিক প্রমোদকক্ষে বোধহয় কোনোদিন বেজে ওঠেনি। উপস্থিত পুরুষ অতিথিদের বিলাসী বক্ষে পার্বত্য উপজাতির রণদামামা বেজে উঠল। এমনই কোনো সুরের তালে তালে পা মিলিয়ে উর্বশী জিতেন্দ্রিয় ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ করতেন। শাজাহানের অতিথিরা আর স্থির থাকতে পারছেন না। মনের নিষেধ অমান্য করেই তাদের দেহ দুলতে শুরু করেছে। মেঝের কার্পেটে জুতোপরা-পাগুলো তাল ঠুকছে। কিছুক্ষণ এমন চললে হ-এর সবাই ডিনার ড্রিংক ফেলে রেখে শাজাহানের ঐতিহাসিক জলসাঘরে নাচতে শুরু করবেন।
গোমেজের খেয়াল নেই। তিনি একমনে কারুর দিকে না তাকিয়ে ক্রমশই সঙ্গীতের গতি বাড়িয়ে যাচ্ছেন। আর আমার মনে হল সেই মুহূর্তে যুগযুগান্তরের নামহীন পরিচয়হীন সংখ্যাহীন যৌবনবতী আনন্দযাত্রীরা একই সঙ্গে মমতাজ হল-এ হাজির হয়েছেন, তাদের বহুজনদৃষ্টিধন্য দেহকে আবার প্রকাশ্যে নিবেদনের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ওই তো আমি কনিকে দেখছি, প্যামেলাকে দেখছি, ফরিদাকে দেখছি, আরও অনেকে ভিড় করে রয়েছে, যাদের বোসদা কিংবা ন্যাটাহারিবাবুহয়তো চিনতে পারতেন। আজ যেন থিয়েটারের কম্বিনেশন নাইট। সম্মিলিত রজনীতে শাজাহানের যুগযুগান্তের অতিথি এবং প্রমোদ বিতরণকারিণীরা সবাই উপস্থিত হয়েছেন। একই ছবির উপর যেন অসংখ্য ছবি সুপার-ইম্পোজ করা হয়েছে। শাজাহানের এই বিশেষ ব্যাংকোয়েটে কেউ বাদ নেই। করবী আছেন, সাদারল্যান্ড আছেন, ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবরা আছেন, সুরাপাত্র হাতে বার-বালিকারা আছেন, আরও অসংখ্য অপরিচিত জনরা আছেন।