বাংকোয়েটে একটি মাত্র জিনিসের অভাব ছিল। সেটি সঙ্গীত। কিন্তু তার অভাবও যে অমনভাবে মিটে যাবে আশা করিনি।
আমাদের উৎসবের মধ্যেই মিস্টার গোমেজ হঠাৎ সান্ধ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজির হলেন।কী ব্যাপার, আমাকে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে! আমাকে ডাকা হয়নি কেন?
বেয়ারাদের একটু গানবাজনার ইচ্ছে, ছিল, কিন্তু ছোটো শাজাহানের নোংরা পরিবেশে তারা গোমেজ সায়েবকে নেমন্তন্ন করতে সাহস করেনি।
প্রতাপচন্দ্র ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে বললেন, জেন্টলমেন, আমার সামর্থ্য থাকলে মিস্টার স্যাটা বোসের এই বিদায়সভায় আমি ভায়োলিন কনসার্টের ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু আমার সে সামর্থ্য নেই। লোকবল থাকলেও, যন্ত্র নেই। গত তিনদিন ধরে মিস্টার স্যাটা বোসের অনারে আমি একটা বিশেষ সুর কম্পোজ করেছি। নাম দিয়েছি—ফেয়ারওয়েল। ফেয়ারওয়েল টু ডিনার, ডান্স, ক্যাবারে; ফেয়ারওয়েল টু ক্যান ক্যান, হুলাহু, রক অ্যান্ড রোল। নাউ জেন্টেলমেন, দিস ইজ পি সি গোমেজ প্রেজেন্টিং টু ইউ এ ভায়োলিন রিসাইটাল—দি ফেয়ারওয়েল কম্পোজড অন দি অকেশন অফ ফেয়ারওয়েল টু মিস্টার স্যাটা বোস।
সব কোলাহল মুহুর্তের মধ্যে যেন স্তব্ধতায় রূপান্তরিত হল। আমরা সবাই বিস্মিত হয়ে গোমেজ এবং তাঁর সেই আশ্চর্য যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওই যন্ত্রের ভাষা শেখবার সুযোগ আমাদের কারুরই হয়নি। কিন্তু তবুও আমাদের কারুরই আজ বোঝবার অসুবিধা হল না। সে আমাদের সকলেরই মনের কথা বলছে।
১৯. সান্টাক্রুজ থেকে বোসদার প্রথম চিঠি
সান্টাক্রুজ থেকে বোসদার প্রথম চিঠি পেয়েছিলাম।
প্রিয় শংকর,
এয়ারওয়েজের দৌলতে এখানের এক হোটেলে এসে উঠেছি। ধোপার ছেলে এবং রাজপুত্রের সেই গল্পটা বার বার মনে পড়ছে। কাপড় কাচতে কাচতে বিরক্ত হয়ে যে ভগবানের কাছে মুক্তির প্রার্থনা করেছিল, ভগবান তাকে বর দিয়ে রাজপুত্র করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজপুত্রের কিছুই ভালো লাগে না। মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র সবাই আসে, কিন্তু রাজপুত্র মনমরা হয়ে বসে থাকেন। শেষে আর থাকতে না পেরে রাজপুত্র বললেন, এসো ভাই আমরা কাপড় কাচা, কাপড় কাচা খেলি। রাজপুত্র সেজে হোটেলের লাউঞ্জে বসে রয়েছি; তোমাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, আর কাপড় কাচা, কাপড় কাচা খেলতে ইচ্ছে করছে।
তোমার সুজাতাদি এখানে ডিউটিতে এসেছিলেন। একদিন দেখা হয়েছে। যা যা ঘটবে তা অবশ্যই তোমাকে জানিয়ে যাব। ঘর-সংসারের কথা তেমন খুঁটিয়ে ভাববার অবকাশ কোনোদিন পাইনি—এখন ক্রমশ লোভ বাড়ছে।
তোমরা আমার ভালোবাসা জেনো।
কয়েকদিন পর বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় সুজাতাদি আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।এই যে শ্রীমান। খবর কী? তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললাম, যাক, তাহলে এখনও সব ভুলে যাননি। সুজাতাদি হেসে বলেছিলেন, একেই বলে নেমকহারাম, হাজার মাইল ফ্লাইট ডিউটি করে হোটেলে এসেই একবস্ত্রে তোমার ঘরে চলে এসেছি। না এসেও বা উপায় কী?
তোমার দাদার অর্ডার, প্রথমেই ওদের খোঁজখবর নেবে।
দাদা কেমন আছেন? প্রশ্ন করলাম। সুজাতাদি বিষণ্ণভাবে বললেন, ও প্রশ্ন করো না। এক মাটির গাছকে শিকড় সুষ্ঠু তুলে নিয়ে অন্য মাটিতে লাগাতে গিয়ে বোধহয় ভুলই করেছি। তোমার দাদা আর সেই আমুদে রসিক দাদা নেই। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। মুখে অবশ্য স্বীকার করতে চান না।
আমি বলেছি, দাদা যাতে আর মনমরা না হতে পারেন, সে ব্যবস্থা করুন! সুজাতাদি একটু লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, সেটা তো
তোমার দাদার উপর নির্ভর করে। আমার কী, আমি তো এখনই চাকরি ছেড়ে দিতে রাজি আছি।
তা হলে বাধাটা কোথায়? দাদার পোবেশন পিরিয়ড! ছমাস পরে, অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিবেন মুক্তির স্বাদ!
সুজাতাদি চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, অনুমতি করলে সাহিত্যিক ঢঙে বলতে পারি, আর কয়েক মাস পরে কোনো নভোচারিণী আমার সত্যসুন্দরদার স্বপনচারিণী হবেন।
সুজাতাদি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, বড্ড ফকে হয়ে যাচ্ছ, এবার কানমলা খাবে।
রোজিকে খুব খুশি মেজাজে দেখছিলাম। সে বললে, আর আমার চিন্তার কারণ নেই। জিমি ম্যানেজার হচ্ছে। জিমির বিদ্যের দৌড় আমার জানা আছে। চিঠিপত্তর লেখা আমাকে না হলে চলবে না।
আমি কোনো উত্তর দিইনি। রোজির মুখেই শুনেছিলাম মার্কোর বিদায় নেবার সময় আগত।
দীর্ঘদেহী মার্কোর বিদায় দিন আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে। বাইরে শাজাহানের গাড়িতে মালপত্তর উঠে গিয়েছিল। বেয়ারারা প্যান্ট্রির সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্য কর্মচারীরাও বাদ যায়নি। সাদা প্যান্ট এবং হাফ শার্ট পরা মার্কোকে অনেকটা নৌবহরের ক্যাপটেনের মতো দেখাচ্ছিল। মার্কোর পাশে জিমিও দাঁড়িয়েছিল। মার্কো একে একে সবার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর বললেন, কিপ দি ফ্লাগ ফ্লাইং। যদি কোনোদিন কোনো কাজে অনেক দিন পরে শাজাহান হোটেলে আমি আসি, তা হলে যেন দেখি জিমির নেতৃত্বে শাজাহান আরও উন্নতি করেছে। জিমিকে মার্কোপোলো গম্ভীরভাবে বললেন, লুক আফটার মাই বয়েজ।
মার্কোপোলোর বিদায়ের পর মনে হল এক শূন্য অভিশপ্ত প্রাসাদে আমি একলা বাস করছি। শীতের দিনে ভারবেলায় আমরা যখন এখানে প্রবেশ করেছিলাম, তখন পান্থশালা আমাদের প্রিয় এবং পরিচিত জনে পরিপূর্ণ ছিল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রেকফাস্টের পর বিদায় নিলেন। দুপুরের লাঞ্চের পরে আরও কয়েকজনকে দেখতে পেলাম না। অপরাহে চায়ের পর অনেকে অদৃশ্য হলেন। রাতের ডিনারের সময় সমাগত। এখন কেউ নেই। সমাজ, সংসার, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন সবাইকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে বৃদ্ধ গৃহস্বামী যেন একা রাতের জনশূন্য ডিনার টেবিলে এসে বসেছি।