তখন হয়তো আমার কথা, তোমার দাদার কথা তোমার মনে পড়বে না। নতুন মানুষদের সঙ্গে বসে এই শাজাহানের ছাদে গল্প করবে।
আমি বললাম, অনেকদিন পরে মনে পড়বে এক শাপভ্রষ্ট পুরুষকে কোনো অজ্ঞাতপরিচয় মহিলা শাজাহান আশ্রম থেকে উদ্ধার করেছিলেন। নারীর কল্যাণস্পর্শে পাষাণে রূপান্তরিত এক পুরুষ-অহল্যা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
সুজাতাদি চুপ করে রইলেন। আজ আমাদের সত্যিই কথা বলবার মতো মনের অবস্থা নেই। সুজাতাদি ও বোসদার মধ্যে হাইফেনের মতো এতদিন আমি ছিলাম। আমারও বোধহয় কিছু কর্তব্য আছে। তাই প্রশ্ন করলাম, চাকরি তো হচ্ছে। আপনাদের নিজেদের পরস্পরকে যাচাই করা শেষ হল কি?।
সুজাতাদি বিষণ্ণ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, আমি তাড়াতাড়িতে বিশ্বাস করি না ভাই। সময় একদিন নিশ্চয় সব সমস্যার সমাধান করে দেবে।
আমি বলেছি, আপনার বাড়িতে কিছু বলেছেন?
সুজাতাদির মুখ এবার আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বাড়ি বলতে লোকে যা বোঝে তা তো আমার নেই ভাই। তোমার দাদার মতো আমিও আত্মীয়হীন। তোমার দাদাকে যেমন ছুটি নিয়ে কোনোদিন দেশে যেতে দেখোনি, আমিও তেমনি ছুটির কথা ভাবি না। মাত্র সেবার এতদিন পরে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় তোমাদের সঙ্গে হৈ-চৈ করলাম। তোমার দাদার তবু সাহেবগঞ্জ আছে, ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। পদ্মার ওপারে, আমাদের সে উপায়ও নেই।
বললাম, সুজাতাদি, আর কেউ না থাক আমি আছি। পৃথিবীর মানুষদের কাছে এত নিয়েছি যে, দেবার কথা ভাবলে ভয় হয়; কত জন্ম ধরে আমাকে এর সুদ গুনতে হবে ঠিক নেই। যদি কারুর জন্যে সামান্য কিছু করতে পারি, বোঝাটা হয়তো একটু হাল্কা হবে।
সুজাতাদি বললেন, অনেক করেছ ভাই। তোমরা ছাড়া আমার কে আছে বলো?
বোসদাকে এবার ফিরে আসতে দেখলাম। অন্ধকারেও ওঁর মুখে বিষণ্ণতার ছাপ দেখলাম। একটা মোড়ার উপর বসে উনি শাজাহানের আকাশকে শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আমরা কোনো প্রশ্ন করবার মতো সাহস না পেয়ে ওঁর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম। সুজাতাদির ইঙ্গিতে শেষ পর্যন্ত আমিই বললাম, কী হল?
সত্যসুন্দরদা একটা সিগারেট বের করে, উদাসভাবে দেশলাইয়ের বাক্সে সেটা ঠুকতে লাগলেন। নিজের মনে ভাবতে ভাবতেই সিগারেটে আগুন দিলেন, তার পর বললেন, কোনো জিনিস তৈরি করতে কত সময় লাগে, অথচ ভাঙতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট। কোটি কোটি দিনরাত্রির মুহূর্ত থেকে তিলে তিলে শাজাহানের যে মধু সংগ্রহ করেছিলাম; এক কথায় তা ঝড়ে উড়ে গেল। মার্কোপোলো বললেন, আমি তোমার পথের প্রতিবন্ধক হব না। পিছনের ব্রিজ পুড়িয়ে দিয়ে, সামনে এগিয়ে যাও ইয়ংম্যান। এমন কি যদি চাও তুমি আমার সঙ্গে আফ্রিকান গোল্ডকোস্টে আসতে পারো। সেখানে দুজনে মিলে আমরা নতুন হোটেল গড়ে তুলব। অনেকদিন আগে মিস্টার সিম্পসন যা করেছিলেন, আমরা এই শতাব্দীতে দুজনে মিলে আফ্রিকাতেও তাই করব। আমার কাগজে মার্কো সই করে দিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন খুবই ব্যস্ত রয়েছেন। জিমিকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে।
বোসদার বিদায় অভিনন্দনের জন্যে আমরা ছোটো শাজাহানকেই নির্বাচন করেছিলাম। শাজাহানের সামান্য কর্মচারীরা বলেছিল, বাবুজি তামাম দুনিয়ায় স্যাটাবাবুর মতো লোক মিলবে না। উনি আমাদের জন্যে কত করেছেন। সায়েবদের সঙ্গে ঝগড়াকরেছেন, ওঁর জন্যেই আমরা এখন ফ্রি চা পাচ্ছি। নিজের পয়সা দিয়ে কতজনের যে চিকিৎসাকরিয়েছেন। উনি না থাকলে রহিমের পায়ের ভেরিকোজ ভেন কোনোদিন কি সারত? আমরাও হুজুর ওঁকে ব্যাংকোয়েট দেব।
ওদের সাধ্যমতো চার আনা করে চাঁদা তুলেছিল। পৃথিবীর কোনো হোটেলের কোনো কর্মচারীর বোধ হয় এমন ব্যাংকোয়েটে উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য হয়নি। সে যে আমাদের অকাল-ব্যাংকোয়েট। হোটেলের ছুটি নেই-ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের সময় লোকদের মরবার ফুরসত থাকে না। তাই ছোট শাজাহানে মধ্যরাত্রে সেই বিদায়সভার অধিবেশন বসেছিল। সেদিন রাত্রে তার আগে কেউ খায়নি। ছোট শাজাহানের বয়রা অতক্ষণ থাকতে রাজি হয়নি, তাই আমাদের সব কর্মীরাই পরিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। টিনের বড় ঘরে, ষাট পাওয়ারের আলোতে সেদিন যে ব্যাংকোয়েট হয়েছিল, তা সত্যিই কোনোদিন ভুলব না। ন্যাটাহারিবাবুর ইচ্ছে ছিল সব গেলাসে একটা করে ন্যাপকিনের রুল দেবেন। কিন্তু অত ন্যাপকিন কোথায় পাবেন? আমাদের সবার জন্যেই কলাই করা থালা, আর মাটির ভাঁড়। কিন্তু বোসদার জন্যে ভালো কাচের ডিস, ছুরি, কাটা। সত্যসুন্দরদার গ্লাসে ন্যাপকিনের ফুলও রয়েছে। ন্যাটাহারিবাবু আমাকে বললেন, কী ফুল করেছি দেখছেন তো-শুয়োরের মাথা নয়, বিশপ।
খেতে বসে দামী ঐকারি দেখে সত্যসুন্দরদা অসন্তুষ্ট হলেন। রহিমকে ডেকে বললেন, ভালো করোনি। শাজাহান থেকে ডিস, ছুরি, কাটা কেন আনতে গেলে, যদি কথা ওঠে?
রহিম বোসদার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললে, না হুজুর, বড়ো শাজাহান থেকে আমরা কিছুই আনিনি। এগুলো আপনার জন্যে নিউ মার্কেট থেকে আমরা কিনে এসেছি।
আমি দেখলাম বোসদার চোখদুটো সজল হয়ে উঠেছে। আমার দৃষ্টি এড়াবার জন্যে তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
আমাদের এই আয়োজন সামান্য হলেও ব্যাংকোয়েটের সব আভিজাত্যই আছে। হাত দিয়ে খেতে খেতে সেই কথাই মনে হচ্ছিল। বোসদাও কাঁটা চামচ সরিয়ে হাত দিয়ে খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ভক্তরা রাজি হয়নি। বলেছিল, না হুজুর, জোগাড় করতে পারলে আমরা সবাই কাঁটা চামচ দিয়ে খেতাম। এটা যে ব্যাংকোয়েট।