ভালোই তো, আপনি তো কোনো অন্যায় করছেন না। আমি বললাম।
ডিসটা নিয়ে খেলা করতে করতেই বোসদা হাসলেন। চকচকে টেবিলের রঙিন কাচে সত্যসুন্দরদার সেই ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে, তার সঙ্গেই তিনি যেন বোঝাপড়া করবার চেষ্টা করছেন। নিজের মনেই বোসদা বললেন, ন্যাটাহারিবাবুর কাছে শুনেছিলাম প্রেমরোগ অনেকটা হামের মতো কমবয়সে স্বাভাবিক, কিন্তু বেশি বয়সে দুশ্চিন্তার কারণ। কথাটা যে নিতান্ত মিথ্যে নয়, তা এখন বুঝতে পারছি।
আমি আবার বোসদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা বললেন, একদিকে ভদ্রমহিলার মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া শক্ত। চাকরিও করেন, কাজও করেন। অথচ মনের মধ্যে ছেলেমানুষ। বাধাবন্ধনহীন এই বোড়ো হাওয়ার ভাবটুকু আমার ভালো লাগে। এই গুণটা সুজাতার মধ্যে তুমি লক্ষ্য করোনি?
ওঁর কোনো দোষ দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। চকোলেট খাইয়ে খাইয়ে আমার নিরপেক্ষ বিচারশক্তি উনি নষ্ট করে দিয়েছেন!
হাসবার চেষ্টা করেছিলেন বোসদা, কিন্তু হাসতে পারলেন না। মনের চিন্তাগুলো দল বেঁধে গায়ের জোরে হাসির গলা চেপে ধরেছে। চাপবারই কথা। বোসদা বললেন, আমাকে ঠিক করতে হবে, শ্যাম রাখব, না কুল রাখব—চাকরি, না সুজাতা?
তার অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও বোসদা শাজাহান হোটেলকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো এক সামান্য পরিচিতা মৃগনয়নার জন্যে তাকে যে হোটেলের সিংহাসন ত্যাগ করার কথা ভাবতে হবে কেউ কি কোনোদিন তা জানত? বোসদা বললেন, সুজাতার ধারণা শাজাহানের রিসেপশন টেবিলে দাঁড়িয়ে আমি নিজের ক্ষমতার অপচয় করছি। এখনও পালাবার সুযোগ আছে। যে অভিজ্ঞতা এখান থেকে জোগাড় করেছি তাতে এয়ারওয়েজেই ভালো চাকরি পাওয়া যেতে পারে।
এ-সব কী বলছেন বোসদা? আমার যেন মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বোসদা বললেন, সুজাতার সঙ্গে এখনও আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো কথা হয়নি; কথা বলবার সময়ও আসেনি। তবে যদি সত্যিই কোনোদিন আমাদের মনস্থির করতে হয়, সেদিন শাজাহানে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
বিয়ের পর এয়ার হোস্টেসের চাকরি থাকবে না। শাজাহানের ম্যানেজারও কিছু ছাদের ঘরগুলোকে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে পরিবর্তিত করবার অনুমতি দেবেন না। যা মাইনে পাই তাতে কলকাতায় আধখানা ঘরও কেউ ভাড়া দেবে না।
ক্যাপ্টেন হগকে দেখেছ নিশ্চয়। আমাদের এখানে প্রায়ই এসে থাকেন। হাওয়াই জগতের বিশিষ্ট লোক। যথেষ্ট প্রতিপত্তি। সুজাতার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। আমার উপরে খুবই সন্তুষ্ট। আমাকে এরোড্রোম বা বুকিং অফিসে একটা ভালো চাকরি দিতে রাজি আছেন। দমদম, উইলিংডন, সান্টাক্রুজ, না কোথায় যেতে হবে ঠিক নেই, কিন্তু সুজাতার ধারণা এখানকার থেকে অনেক কম কষ্ট করে আমি অনেক সুনাম অর্জন করতে পারব! বোসদা এবার আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
কী বলব আমি? বোসদা নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না। চায়ের কাপটা অবহেলাভরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, শাজাহানের বাইরে আমি বেঁচে রয়েছি এ-কথা কিছুতেই ভাবতে পারছি না। নাই-বা হলো বড় চাকরি; নাই-বা পাওয়া গেল অনেক টাকা। কিন্তু বেশ সুখে রয়েছি। এমন স্বাধীনতা, প্রতিমুহূর্তে জীবিকার এমন রোমাঞ্চ আর কোথায় পাব?
না বলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার। আমাদের এমন নিশ্চিন্ত সংসার থেকে বোসদার মতো শুভার্থীকে হারাতে আমার স্বার্থপর মনটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু কেমন করে তাকে সুখ এবং পরিপূর্ণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখব? বললাম, না বোসদা, আপনি যান। সুযোগ জীবনে সব সময় আসে না। দেরিতে হলেও সে যখন এসেছে তাকে গ্রহণ করুন।
তাঁর দুটো উষ্ণ হাত দিয়ে বোসদা আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,গত জন্মে নিশ্চয়ই তুমি আমার আপন ভাইছিলে। এতদিন শাজাহানে কাজ করছি। কখনও কাউকে এত ভালোবাসিনি। সেই যেদিন প্রথম তোমায় দেখলাম, সেই মুহূর্তেই আমি হেরে গেলাম—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
বোসদার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠল না। কেমন করে বোঝাব, আমার জীবনের কতখানি অংশ তিনি জুড়ে রয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে আমার শাজাহান-অধ্যায়ের কী অবশিষ্ট থাকে?
বোসদার চাকরির ব্যবস্থা যে পাকা হয়ে গিয়েছে, তা তাঁর কাছ থেকেই শুনেছিলাম। হোটেলকে কবে নোটিশ দেবেন ভাবছিলেন। বললাম, দেরি করবেন না। শাজাহানে অনেক পরিবর্তন আসছে মার্কোরও যাবার সময় আসন্ন।
বোসদা শুনে চমকে উঠেছিলেন। মার্কোও চলে যাচ্ছেন? এবার নিশ্চয়ই জিমির বহুদিনের স্বপ্ন সম্ভব হবে। শাজাহানের গদিতে এবার সে জাঁকিয়ে বসে রাজ্য চালাতে পারবে। একদিক থেকে নৈরাজ্যও বলতে পারো।
বললাম, এমন কথা বলছেন কেন?
লোকটাকে চিনতে আমার অন্তত বাকি নেই। যেমন চোর, তেমন কুঁড়ে, তেমন হিংসুটে, তেমন অপদার্থ। দল পাকাবার রাজা। আমাকে এখনই তাহলে কথা বলতে হয়। মার্কো থাকতে থাকতে রেজিগনেশন অ্যাকসেপ্ট না হলে, আমাকেও ভুগতে হবে।
মার্কোর সঙ্গে বোসদা যখন দেখা করতে গিয়েছিলেন, আমি ছাদের উপর সুজাতাদির সঙ্গে বসেছিলাম। সুজাতাদি একটু পরেই নাইট ফ্লাইটে চলে যাবেন। সুজাতাদি বললেন, তোমার খুব খারাপ লাগছে, তাই না? বোধহয় আমি তোমাদের সাজানো জীবনে বিপর্যয় এনে ভুল করলাম।
আমি বললাম, সুজাতাদি, কেন আর কষ্ট দিচ্ছেন? একদিন আমার সব সহ্য হয়ে যাবে।