বায়রন বলল, ওঁরা দুজনে এক সঙ্গে থাকবেন ঠিক করেছেন। এই কদিনের চিকিৎসাতে লিজা অনেক পালটিয়ে গিয়েছে, দেখলে তুমিই অবাক হয়ে যাবে। লিজার একদিন শাজাহানে আসবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মার্কো রাজি হননি। অন্য কেউ কিছু না বলুক, জিমিকে চিনতে ভঁর তো বাকি নেই। ম্যানেজারের বদনাম হোটেলের বদনামে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগে না।
বায়রনের মুখেই শুনলাম, মার্কোর বিদায় সংবাদ আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই পাব। লিজাকে বিয়ে করা এখানকার আইনে সম্ভব নয়। অথচ বিয়ে না করে, একসঙ্গে থাকবার মতো প্রবৃত্তি তার নেই। তাই মার্কো অন্য পথ বেছে নিয়েছেন। আফ্রিকান গোল্ডকোস্টে একটা চাকরি জোগাড় করেছেন। সে-দেশে এখনও বহুবিবাহে আপত্তি নেই। আলোক প্রাপ্ত ইউরোপ এবং সভ্য এশিয়া থেকে দূরে আফ্রিকার স্বল্পালোকিত সামান্য শহরের এক সামান্য হোটেলে ভাগ্যহত মার্কো এবং জনম দুঃখিনী লিজা স্বামী-স্ত্রী রূপে জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে দেবে-আইনের অনুমোদনের জন্যে তারা আর ভারত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে থাকবে না।
বায়রন এবার একটু ইতস্ততঃ করলেন। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমারও ভালো হল। ওঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম বলে, এতদিন আমার পক্ষেও নড়া-চড়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমারও দায়িত্ব শেষ হল; এবার আমারও বিদায় নিতে কোনো বাধা রইল না।
মানে? বিস্ময়ে আমি বায়রনের মুখের দিকে তাকালাম।
বায়রন বেদনার্ত স্বরে বললেন, যতদিন প্রফেশনে ছিলাম, ততদিন কখনও বলিনি। আজ বলছি, কলকাতায় আমাদের সমাদরের কোনো সম্ভাবনা নেই। এদেশের লোকেরা নভেলে সিনেমায় থিয়েটারে প্রাইভেট ডিটেটিভদের সমাদর করতে রাজি আছে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের কথা একবারও মনে করে না। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় তেমন নয়। সেখানে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের অনেক সুযোগ রয়েছে। ডিটেকশন কোম্পানিতে আমি মাসিক মাইনের চাকরিও নিতে পারি। তেমনই একটা চাকরি এতদিনে জোগাড় হয়েছে। এখন তারই ভরসায় পাড়ি দিচ্ছি। পরে সুযোগ বুঝলে আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিশ করব।
বায়রনের হাত দুটো আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম, বলেছিলাম, ঈশ্বর যে এতদিনে আপনার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন, ভাবতে আমার আনন্দ হচ্ছে। আপনি এতদিনে সত্যি সুখী হবেন।
কেমন করে বুঝলে? বায়রন বেদনার্ত হাসিতে মুখ ভরিয়ে প্রশ্ন করলেন।
কেমন করে বুঝলাম? আইনের ভাষায় বলতে গেলে, নজির আছে।
নজির? বায়রন আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন।
যাঁর সুখ শান্তি পাবার প্রয়োজন ছিল, অথচ যাঁর দুঃখ আমাদের মর্মবেদনার কারণ হয়েছিল এমন একজন ভদ্রলোক বহু বছর আগে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে শান্তি লাভ করেছিলেন।
কে তিনি? বায়রন প্রশ্ন না করে থাকতে পারেনি। তখন বলেছিলাম, তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ না। কিন্তু আমার পক্ষে কিছুতেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয়, তিনি ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড উপন্যাসের একটা চরিত্র মাত্র। তার নাম মিস্টার মিকবার।
১৮. কোনো কর্মহীন অলস অপরাহ্নে
কোনো কর্মহীন অলস অপরাহ্নে আত্মীয়হীন গৃহকোণে নিঃসঙ্গ আপনি কখনও কি বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের কথা চিন্তা করেছেন? প্রকৃতির বিশেষ কোনো পরিবেশে মনের মাটিতে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন লোভী মনের কাছে পাওয়া থেকে না পাওয়াটাই হয়তো বড়ো হয়ে ওঠে। কিন্তু স্মৃতির ভারে জর্জরিত বিষণ্ণ মন যখন সুযোগ বুঝে সুদূর অতীতের দিকে দৃষ্টি দিতে শুরু করে, তখন পাওয়া এবং না পাওয়া থেকে, পেয়ে হারানোর বেদনা আরও বড়ো হয়ে ওঠে। শাজাহানের বিস্ময়ভরা পরিবেশে একদিন যাদের পেয়েছিলাম, সত্যিই যে তাদের হারাতে হবে, তা বুঝিনি।
হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের কামরায় বায়রনকে যেদিন তুলে দিয়েছিলাম সেদিন সত্যিই হারিয়ে যাওয়ার বেদনা অন্তরে অনুভব করেছিলাম। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বায়রন শেষবারের মতো সত্যসুন্দরদা এবং আমার সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। তিনি আমার কেউ নন, এমন কিছু দীর্ঘদিনের পরিচয়ও ছিল না, তবু শূন্যতা বোধ করেছিলাম।
কিন্তু সেই যে শুরু, তা কেমন করে জানব! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোসদাকে বলেছিলাম, এবার পা চালানো যাক, সেই কখন হোটেল থেকে দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছি।
সত্যসুন্দরদা কিন্তু কোনো ব্যস্ততা দেখালেন না। বললেন, উইলিয়ম রয়েছে, জিমি রয়েছে, ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে, আমার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। শাজাহানের চা ছেড়ে হাওড়া স্টেশনের চা কেমন করে সত্যসুন্দরদার ভালো লাগবে?
রেস্তোরাঁয় ঢুকতে ঢুকতেও কিছু বুঝতে পারিনি। চেয়ারে বসে সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
আমি সত্যসুন্দরদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা একটু লজ্জিত এবং দুঃখিত হয়েই বললেন,কী ছিলাম আর এখন কোথায় হাজির হয়েছি। নিজেকে এতদিন লোহার তৈরি বলে মনে করতাম। এখন বুঝলাম, সব ভুল।
বোসদার কথায় আশ্চর্য হয়ে ওঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। বোসদা এবার সঙ্কোচ কাটিয়ে বললেন, তুমি আমার ছোট ভাই-এর মতো; শাজাহান হোটেলে তুমি আমার একমাত্র বন্ধুও বটে। তোমার পরামর্শ আমার প্রয়োজন।
প্রয়োজনের সময় বোসদা সে আমার কথা ভেবেছেন তা মনে করে সত্যিই আমার আনন্দ হল।
একটা খালি ডিস নাড়তে নাড়তে বোসদা বললেন, এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। আর মুলতবি রাখলে চলবে না। সুজাতাকে আজই উত্তর দেব বলে কথা দিয়েছি। এতদিন সহজভাবে কাটিয়ে এসে এবার যে মনটা আমার বিদ্রোহ করে উঠবে তা কল্পনারও অতীত ছিল।