মেমসায়েব বলেছিলেন, বেশি পাকামো না করে, ওইখানে চুপচাপ বোসো। না হলে কানমলা খাবে।
কান বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, মলুন—আমার একটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে থাকবে। পৃথিবীর প্রথম দায়িত্বশীল রিসেপশনিস্ট, যার কর্ণজনৈক মহিলা অতিথি কর্তৃক মলিত হয়েছিল!
জোর করে একটু চা আনিয়েছিলাম। সে চা-এর ট্রে সুজাতাদির সামনে দিয়ে বলেছিলাম, আমরা গাট হয়ে বসলুম। আপনি টি তৈরি করে সার্ভ করুন।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বোসদা আবার বলেছিলেন, কী ছেলেমানুষি করলেন বলুন তো? এই স্কুটার নিয়ে কী করব, রাখব কোথায়?
এত বড়ো হোটেল, যেখানে ডজন ডজন মোটর দাঁড়াতে পারছে, সেখানে একটা স্কুটার রাখা যাবে না! এ আমি বিশ্বাসই করি না। আর ওটা নিয়ে কী করবেন?মাঝে মাঝে এই জেলখানা থেকে বেরিয়ে, গড়ের মাঠের উদার উন্মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করবেন। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্রি হোটেল হোটেল করে নিজেকে অবহেলা করবেন না।
বোসদা তখনও গম্ভীর হয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুজাতাদিবলেছিলেন, যদি কোনো দোষ করে থাকি, কী করে অপরাধ মার্জনা সম্ভব বলুন?
আপনার শাস্তি হল একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, সেদিন যেমন গুনগুন করে পার্কে গাইছিলেন। এটাও আপনার একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে, প্রথম অতিথি যিনি হোটেলে গান না শুনে, নিজেই গান শুনিয়েছিলেন,আমি বললাম।
সুজাতাদির আপত্তি ছিল না। কিন্তু বোসদা বারণ করলেন। বললেন, ছাদে আরও অনেক লোক আছে। জানাজানি হলে বিশ্রী ব্যাপার হবে।
সুজাতাদি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়েছিলেন। আমরা দুজনে তখনও স্থির হয়ে বসে রইলাম। বোসদা বললেন, ওহো, তোমাকে বলা হয়নি। বায়রন সায়েব ফোন করেছিলেন। উনি আজই তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া নাকি বিশেষ প্রয়োজন।
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। বোসদা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার যেন তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। যেন বিরাট পরিবর্তনের সবুজ সিগন্যাল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা বললেন, মার্কোর ব্যাপার-স্যাপার তেমন সুবিধে নয়। কয়েকদিন রাত্রে হোটেলেই ফেরেননি। ছাতাওয়ালা লেনেই সময় কাটিয়ে এসেছেন। জিমিটাও এই সুযোগে ভিতরে ভিতরে দল পাকাবার তালে রয়েছে।
আমি বললাম, বায়রনের সঙ্গে দেখা হলে কিছুটা হয়তো জানা যাবে।
বোসদা বললেন, হাজার হোক মানুষটা ভালো। ওঁর দুঃখ দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়।
সেই রাত্রেই বায়রন সায়েব দেখা করতে এসেছিলেন। সেই সাক্ষাতের পর বিবরণ আমার স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
এতদিন পরে লিখতে বসেও চোখের জলকে বাধা দিতে পারছি না। চোখের জলে নিজেকে প্লাবিত করা হয়তো পুরুষের পক্ষে শোভন নয়। কিন্তু কেমন করে বোঝাব, অপরিচিতের প্রীতি কেমনভাবে নিশ্চিত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করে আমার জীবনকে বার বার সজীব ও সরল করে তুলেছে। গভীর গহন অন্ধকারে হৃদয়হীন জীবন-দেবতার মুখোমুখি যারা দাঁড়িয়েছে, হয়তো একমাত্র তাদেরই পক্ষে তা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। কিংবা আমার অক্ষমতা। যা অনুভব করি, বুকের প্রতিবিন্দু নিশ্বাসের সঙ্গে যে কথা বলতে চাই, তা যদি সত্যিই আমি প্রকাশ করতে পারতাম, অন্তত তার কিছুটাও যদি প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলে সত্যিই আমার আনন্দের শেষ থাকত না। জীবনের চরমতম পরীক্ষার মুহূর্তে কোনো অচেনা পাঠকের অন্ধকার মনে সামান্য আশার আলো জ্বালাতে পারলে, বায়রন সায়েবের উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা জানানো হবে।
বায়রন আমার ঘরে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মার্কোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছি আমি। মনে মনে দুঃখ ছিল, বেচারার জন্য কিছুই করে উঠতে পারলাম না।যদি বা সুশানের খবর পাওয়া গেল, তাতে কিছুই লাভ হল না। সুশান তো আর আমাদের নাগালের মধ্যে নেই। সুতরাং পুরনো ডাইভোর্স মামলার মাধ্যমে মুক্তি পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। বায়রন একটু থামলেন। তারপর বললেন, কিন্তু ঈশ্বর এমনি করেই বোধহয় অভাজনদের উপর কৃপাবর্ষণ করেন।
আমি ওঁর মুখের দিকে পরম কৌতূহলে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, একদিন সবাই জানতে পারবে। তবে তোমার বোধহয় আগে থেকে জানবার অধিকার আছে।বায়রন একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, তোমরা বলো রাম না জন্মাতেই রামায়ণ গাওয়া হয়েছিল। মার্কোর জীবনেও প্রায় তাই হল। লিজাকে একদিন সাক্ষী হিসাবে খাড়া করবার জন্যে, পয়সা দিয়ে ওকে নিয়ে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন মার্কো। আর এতদিন পরে, মার্কো সত্যিই লিজার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। লিজা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তারপর যখন সে সত্যিই বুঝল মার্কোর মনে কোনো কু-অভিসন্ধি নেই, তখন সে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল।
তুমি যদি দেখতে মার্কো কীভাবে অসুস্থ লিজার সেবা করেন। সেদিন নিজের চোখে দেখলাম, দুহাতে তার বমি পরিষ্কার করছেন মার্কো। কী আছে ওর শরীরে? মার্কোপোলোকে দেবার মতো কোনো নৈবেদ্যই তার নেই। তবু মার্কো ওর মধ্যে কী যে খুঁজে পেয়েছেন!
মার্কো বলেন, মনে আছে যেদিন প্রথম সুশানের সঙ্গে তোমার বাড়িতে গিয়ে ছিলাম?
লিজা বলে, তোমার কাছে টাকা চাইতে সেদিন আমার যে কী কষ্টহয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে তখন একটা আধলাও ছিল না। বাথরুমে পিছলে পড়া সেই যে আমার কাল হল; তারপর থেকে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারলাম না।