সত্যসুন্দরদার দ্বিধার পরিচয় একদিন কাউন্টারেই পেয়েছিলাম। সারারাত ডিউটি করে, আমাকে চার্জ দিয়ে যখন চলে গিয়েছিলেন, তখন দেখেছিলাম প্যাডের ওপর হিজিবিজি করে বোসদা অনেকবার কী একটা লিখেছেন। একটু চেষ্টা করতেই পাঠোদ্বার হয়েছিল। বোসদার কাছেই কথাটা যে অনেকবার শুনেছি—The wise receptionist keeps the counter between, in spirit as well as in fact. কাউন্টারের বাঁধ বন্যাকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না বলেই বোধহয় বোসদা নিজেকে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। তারপর এতই অন্যমনা ছিলেন যে, কাগজগুলো ছিড়ে ফেলতেও ভুলে গিয়েছিলেন।
কেন জানি না, আমার খুব ভালো লেগেছিল। সত্যসুন্দরদার মতো মানুষ চিরকাল এমনভাবে শাজাহানের অপরিপূর্ণ জীবনযাপন করবেন, তা ভাবতে সত্যিই আমার মন খারাপ হয়ে যেত।
যখন হয়, তখন বোধহয় এমনি করেই হয়। তখন কারুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মুখ চেয়ে যা ঘটবার, তা থমকে দাঁড়ায় না। তাই সুজাতা মিত্র এবার ঘন ঘন হাওয়াই ডিউটিতে কলকাতায় আসতে আরম্ভ করেছেন। তিনি যে কবে আমার সুজাতাদি হয়ে গিয়েছেন, তা-ও বুঝতে পারিনি। গল্প করতে ভালোবাসেন সুজাতাদি। হাসতে পারেন, হাসাতে পারেন সুজাতাদি। সুতরাং আমার সঙ্গে ভাব জমে উঠতে বেশি দেরি হয়নি।
আমাদের ডিউটি-রস্টারও সুজাতাদির জানা হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে স্নান শেষ করে, সুজাতাদি আজকাল লজ্জা কাটিয়ে সোজা উপরে চলে আসতেন। আমাকে বলতেন, চোখ বোজো। আমি চোখ বুজতাম। সুজাতাদি বলতেন, হাঁ করো, আমি হাঁ করতাম। সুজাতাদি সঙ্গে সঙ্গে মোড়ক খুলে একটা চকোলেট কিংবা লজেন্স মুখে ফেলে দিতেন। স্বাদ নেবার জন্যে আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করতাম। দ্রুত আঙুল সরিয়ে নিতে নিতে তিনি বলতেন, এখনি আমার আঙুলটা কামড়ে দিয়েছিল আর কি। যা লোভী ছেলে!
আমি বলতাম, লোভী বলছেন কেন? বদনাম যখন হয়েছে, তখন আর একটা চাই। সত্যদাকে বলতেন, এবার চোখ বুজে, আপনি হাঁ করুন।সত্যদা মাথা নাড়তেন।না দেখে আমি ওভাবে কিছু মুখে পুরতে চাই না। শাজাহানের একটা মূল্যবান জীবন ওইভাবে রিস্ক করতে পারি না।সুজাতাদি বলতেন,ঠিক আছে, এতটুকু যখন বিশ্বাস নেই, তখন খেতে হবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, যখন আপনাদের মধ্যে গণ্ডগোল চলছে, তখন আপনাদের ভাগের চকোলেটগুলোও আমাকে দিন! বোসদা বলেছেন,ওরে দুষ্টু ছোকরানা মিস্ মিত্র, আমার চকোলেটের ভাগটা আমাকে দিন।
সুজাতাদি যেদিন কলকাতায় থাকতেন, সেদিন আমাদের ছাদটা একেবারে পালটিয়ে যেত। বোসদার ঘরের মধ্যে সুজাতাদি হয়তো জোর করে ঢুকে পড়তেন, সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে আমাকে বলতেন, আপনার দাদার যেমন সাজানো গোছানো স্বভাব, তাতে মেয়েরাও লজ্জা পাবে।
বললাম, ভালোই হল। এতই যখন প্রসন্ন হয়েছেন, তখন আজকের রাতের তিনখানা সিনেমা টিকিটের দাম আপনি দিন!
সুজাতাদি বলেছেন, গ্ল্যালি। হ্যান্ডব্যাগ খুলে সুজাতাদি পয়সা বের করতে যাচ্ছিলেন। বোসদা বললেন, আপনিও যেমন! আপনি আজ আসবেন বলে চারদিন আগে শ্রীমান নাইট শোয়ের তিনখানা টিকিট কেটে রেখেছে।
সুজাতাদি বলেছেন, ছিঃ, বয়সে ছোট না!
আজকালকার ছেলে-ছোকরারা সেসব যদি মানত! বোসদা বললেন।
ছবিটা বড় ছিল। বারোটার আগে শেষ হয়নি। মেট্রো সিনেমা থেকে বেরিয়ে সেদিন যেন চৌরঙ্গীকে আমরা আরেক রূপে দেখেছিলাম। ট্যাক্সি করতে যাচ্ছিলাম, বোসদা হাঁটবার প্রস্তাব করলেন।
মধ্যরাত্রে কলকাতাকে আমি নানা দিনে নানাভাবে দেখেছি। কলকাতার সেই রূপকে সত্যিই আমি ভয় করি। কিন্তু আজ অন্য রকম মনে হল! চৌরঙ্গী ও সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে স্যর আশুতোষের স্ট্যাচুর সামনে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমরা একটা স্কুটার যেতে দেখলাম। কলকাতার রাস্তায় তখনও স্কুটারের ছড়াছড়ি ছিল না। বোসদা বললেন, হায় রে, আমার যদি এমন একটা স্কুটার থাকত!।
সেই সামান্য রসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে সুজাতাদি যে সত্যই বোসদার জন্যে একটা স্কুটারের ব্যবস্থা করবেন, তা আমাদের কল্পনার অতীত ছিল। সুজাতাদি আমার চালাক মেয়ে, তাই প্রথমেই বলেছিলেন, আমি একটা কাজ করে ফেলেছি; তার জন্যে আমাকে যদি একটা কথাও বলেন তাহলে আমি সত্যিই দুঃখ পাব।
বোসদা প্রথমে ঠিক বুঝতে না পেরে বলে ফেলেছিলেন, ভুল মানুষ মাত্রই করে। তার জন্যে আপনাকে বকতে যাব কেন?
ঠিক তারপরই সুজাতাদি স্কুটারের কাগজপত্তর বোসদার হাতে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, দুএকদিনের মধ্যে যখন গাড়িটা এসে পৌছবে তখন সুজাতাদি কলকাতায় থাকতে পারবেন না। এবার ফিরতেও সপ্তাহখানেক দেরি হবে। তার মধ্যে চালানোটা যেন ভালো করে অভ্যাস করা থাকে। তবে কলকাতার গাড়ি-ঘোড়ার যা অবস্থা, এখানে স্কুটারের কথা ভাবলেই ভয় হয়।
নিজের প্রতিজ্ঞাতে আবদ্ধ বোসদা রাগে গুমরে গুমরে মরছিলেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত অভিযোগ করলেন—কী একটা ছেলেমানুষি করলেন, বলুন তো!
সুজাতাদি হেসে বলেছিলেন, সব দোষ ব্যুমেরাঙের মতো আপনার কাঁধেই ফিরে আসবে। কারণ হোটেলের কেউ তো আর স্কুটারের পিছনে আমার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারবে না!
আর জানলে আমাদের দুজনেরই এখানে টেকা মুশকিল হবে! আমি বলেছিলুম।
সে-রাত্রে ছাদে বসে বসে অনেক কথা হয়েছিল। গুড়বেড়িয়া দেশে গিয়ে নব-বধূর মোহিনী মায়ায় ছুটি বাড়াতে প্রলুব্ধ হয়েছিল। মায়ের শারীরিক অসুস্থতা সম্বন্ধে তাই আর একটা টেলিগ্রাম এসেছিল। গুড়বেড়িয়ায় অনুপস্থিতিতে আমিই বেয়ারার কাজ করছিলাম। ওঁদের সামনে দাঁড়িয়ে সেলাম করেছিলাম, মেমসায়েবের কোনো অর্ডার আছে?