সত্যিই আমার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। পান্থশালায় অগণিত অতিথির দিবারাত্রির আগমন নির্গমন এখন আর তেমনভাবে আমার মনে রেখাপাত করছে না। খেয়াঘাটে বসে বসে অতীত দিনের সহযাত্রীদের কথাই অপেক্ষমান যাত্রীর বার বার মনে পড়ছে। আমার হতশ্রী শিথিল স্মৃতি হঠাৎনবযৌবন লাভ করেছে। বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে বিবর্ণ ছবিগুলো আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দু-নম্বর সুইটের সামনে দাঁড়ালেই করবী গুহের কথা মনে পড়ে যায়। রাতের ক্যাবারে উৎসবে দাঁড়ালেই কনি ও ল্যামব্রেটাকে দেখতে পাই। বার-এ দাঁড়ালেই বহু বর্ষ আগের এক অসহায় বারবনিতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছাদে উঠলেই দেখি দীর্ঘদেহ ডাক্তার সাদারল্যান্ড উইলিয়ামস লেনের লোকাল বয়েজদের কথা চিন্তা করছেন।
তবু এরই মধ্যে জীবন চলেছে। অনেকদিন আগে সিম্পসন নামে এক ইংরেজ ভগীরথ যে স্রোতস্বিনীকে আমাদের এই মরুভূমিতে আহ্বান করেছিলেন, তার গতি ধীর হলেও, আজও তা স্তব্ধ হয়নি। মমতাজ-এর বার-এ দাঁড়িয়ে ড্রিঙ্কের হিসেবনিকেশ করতে করতে সরাবজী তাই মেয়ের কথা চিন্তা করেন, তার নিজেরও যে একটা বার ছিল তা কিছুতেই ভুলতে পারেন না। উইলিয়াম ঘোষ অন্য এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করেছে। স্টেটসম্যানের এনগেজমেন্ট স্তম্ভে সে সংবাদ পয়সা দিয়ে ছাপানো হয়েছে।
আর বেচারা রোজি, তার বাবা-মার অসুখ বেড়েছে। চিকিৎসা করাতে পারছে। টাকার জন্যে মেয়েটা হন্যে হয়ে উঠেছে।
ফোকলা চ্যাটার্জি প্রায়ই রোজির সঙ্গে কথা বলেন। আমাকেও জানালেন, আপনাদের রোজি মেয়েটা বেশ। মিস্টার সদাশিবমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। হাই অফিসার সদাশিবমের হাতে অনেক ক্ষমতা। মশায়, আগে প্রায়ই যেতাম। কিন্তু শুধু ল্যাজে খেলত। শেষে একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বললে, যা চাইছ তাই করিয়ে দেব; কিন্তু বিকেলে বড় লোনলি ফিল করি। তা মশায়, দিলুম আপনাদের রোজির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে। এখন প্রায়ই অন্য হোটলে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন ওঁরা। সদাশিবমের ওয়াইফ বোধহয় লাস্ট এক বছর বাপের বাড়িতে রয়েছে। আমার কী! আমাকেও তো কোটা, পারমিট, অর্ডার জোগাড় করে বেঁচে থাকতে হবে। দুনিয়ার যত মাল কি স্না পারচেজ অফিসার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর বুশ-সার্ট-পরা হাই অফিসারই এনজয় করে যাবে? আমাদের মত সাধারণ ইনোসেন্ট লোকদের কি মালের তেষ্টা লাগে না?
ফোকলা চ্যাটার্জি বলেছিলেন, দুঃখের কথা বলব কি, দেশে আপনারা অভাব অভাব বলেন, অথচ বিজনেস লাইনে আমরা মেয়ে পাচ্ছি না। একজন বাঙালি হিসেবে বলছি, বেঙ্গলি মেয়েদের সবাই চায়! সুযোগ রয়েছে, সুবিধে রয়েছে তবু লাইনে আসবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে ফোকলা চ্যাটার্জির বদনাম হয়ে যাবে। বাপু, আগে খেয়ে পরে সুখে বেঁচে থাক,তারপর তো ধর্ম। হচ্ছেও তাই—অ্যাভারেজ বেঙ্গলি মেয়ে আর সেফ নয়—বুকের মধ্যে সব টি-বি। অথচ এমন জাত, ভাঙবেতবুমচকাবে না। বঙ্কিম, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ এঁরাই জাতটাকে ডোবালেন। এখন অন্য যুগ, এখন প্র্যাকটিক্যাল লোক চাই। একা আমি ফোকলা চ্যাটার্জি কী করব মশাই? এই দেখুন না, আগরওয়ালা একজন হোলটাইম বাঙালি হোস্টেস চাইছে। ভালো মাইনে দেবে। দুহাতে এক্সট্রা ইনকাম। কিন্তু একটা মনের মতো লোকাল মেয়ে পাচ্ছি না। রোজিটা আমাকে খুব ধরেছে। চাকরিটা করে দিতেই হবে। ঘুড়ির নাকি অনেক টাকা দরকার। তা ভাবছি ওকেই করে দেব—আফটার অল পভার্টি নোজ নো কাস্ট। বিপদ আপদে সব মানুষকেই দেখতে হয়। সে যে জাতের হোক। তাই না?
ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন, দেখি কী করা যায়। বেটা সদাশিবমটাই গণ্ডগোল বাধিয়েছে। মালের রোজিকে ভালো লেগে গিয়েছে, ওকে হাতছাড়া করতে চাইছে না, আমরাও ওকে চটাতে পারি না। এখন ক্রমশ কানে মন্তর দিচ্ছি, একই কাপডিসে বার বার চা না খেয়ে, রোজ ভাঁড়ে চা খাও।
ফোকলা চ্যাটার্জি যাবার আগে বলেছিলন, আপনাকে একটা সুখবর দিই। আমি আগরওয়ালা কোম্পানির ডিরেক্টর হচ্ছি। চুরি-জোচ্চুরি না করেও, কেবল অনেস্ট লেবার দিয়ে মানুষ এখনও উন্নতি করতে পারে।
সত্যসুন্দরদাও আর-এক আশ্চর্য জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। হাওয়াই কোম্পানির যাত্রী এবং কর্মীবাহী বাসের দিকে আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি। হয়তো এখনই পাড়বিহীন নীলাম্বরী শাড়ি পরে সুজাতা মিত্র আমাদের কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াবেন।
কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটা ডান হাতে ধরে, মিষ্টি হেসে সুজাতা বলবেন, সব ভালো তো? সত্যসুন্দরদা বলবেন, আপনার খবর কী বলুন?
মনের প্রকৃত ভাব চেপে রাখার চেষ্টা করে সুজাতা মিত্র বলবেন, খুউব ভালো ছিলাম। কোনো চিন্তা ছিল না, উদ্বেগ ছিল না। পৃথিবীর এক দেশে ব্রেকফাস্ট করে, আর-এক দেশে লাঞ্চ খেয়ে, অন্য আর-এক দেশে বিকেলে সিনেমা দেখে ফুর্তিতে ছিলাম।
কয়েকবার এমন দেখাতেই যে সত্যসুন্দরদার মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝেছিলাম। তবু সত্যসুন্দরদা মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় চমকে উঠতেন। অবাধ্য মনটাকে শত চেষ্টাতেও তিনি বশে আনতে পারছিলেন না।
এবিষয়ে আমার কাছেও নিজেকে প্রকাশ করতে সত্যসুন্দরদা বোধহয় সঙ্কোচ বোধ করতেন। তাই নিজের মনের মধ্যেই নিজেকে বন্দি করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।