বিজয়গর্বে বিগলিত ভদ্রমহিলা গম্ভীরভাবে বললেন, পৃথিবীর যেখানেই যাচ্ছি দেখছি ওরা রুচি নষ্ট করে দিচ্ছে। চিউইং গাম চুষতে চুষতে ওরা সৌন্দর্যের উপর বুলডজার চালাচ্ছে। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, পয়সা হয়তো ওদের আছে, কিন্তু রুচি শিখতে এখনও অ্যানাদার ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ার।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে মার্কোপোলো বেরিয়ে এলেন। পরে স্যাটা বোসের কাছে শুনেছি, যদি ভদ্রমহিলা আমেরিকান হতেন, তা হলে মার্কো বলতেন, ইংরেজরা কেন যে এই সেকেলে রং পছন্দ করে বুঝি না। অথচ আমরা নিরুপায়—গতকাল পর্যন্ত ক্যালকাটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর। তবে এখন আমরা উঠে পড়ে লেগেছি—ব্রিটিশ ইমপিরিয়ালিজমের সব চিহ্ন এখান থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।
গেস্টদের কাছে নরম মেজাজের শোধটা ম্যানেজার অবশ্য কর্মচারীদের উপর দিয়ে তুলে নেন। বেয়ারা, ফরাশ, খিদমতগার, বাবুর্চির প্রাণ বড় সায়েবের দাপটে ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
মার্কোপোলো সায়েব একদিকে আরও ভয়াবহ। ওঁর মেজাজ কখন যে কত ডিগ্রিতে চড়ে রয়েছে তা সবসময় বোঝা যায় না।
আমাকে কাজ দেওয়ার সময়ও মার্কো কেমন গম্ভীর হয়ে থাকেন। সব সময়েই যেন অন্যমনস্ক। সন্ধের সময় মাঝে মাঝে হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট পরে, ছড়িটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কোথায় যান কেউ জানে না। ডিনারের সময়, যখন ডাইনিং হল্-এ তিলধারণের স্থান থাকে না, তখনও তাঁকে দেখা যায় না। বেচারা স্টুয়ার্ড এবং সত্যসুন্দরবাবুকে সব সামলাতে হয়।
স্টুয়ার্ড বলে, স্যাটা, এমনভাবে কতদিন চলবে?,
স্যাটা বলেন, অতো মাথা ঘামিও না, সায়েব। দেড়শ বছর ধরে যে জিনিসটা চলে আসছে, সেটা ঠিক নিজের জোরেই চলবে। তোমার কিংবা আমার ব্রেনের ব্যাটারি সেজন্যে অহেতুক খরচ করে লাভ নেই।
ম্যানেজার সায়েব যখন ফিরলেন, তখন তার অন্য মেজাজ। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘরে ঢুকে সায়েব জামা-জুতো একটা একটা করে খুলে চারদিকে ছুড়ে ফেলতে আরম্ভ করেন। বেচারা মথুরা সিং চুপচাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরে ঢুকে কোনো লাভ নেই, নেশার ঝেকে সায়েব হয়তো জুতো ছুড়েই মারবেন।
একটু পরেই মথুরা সিং-এর ডাক পড়ে, ঘরে ঢুকতেই জড়িত কণ্ঠে সায়েব বলেন, হেড বারম্যান কো বোলাও।
সেলাম পেয়েই হেড বারম্যান রাম সিং ব্যাপারটা বুঝতে পারে। কোমরে লাল পট্টি, ডান হাতে লাল ব্যান্ড এবং মাথার লাল পাগড়ি পরে সে পেগমেজারে মদ ঢালছিল। অন্য কারুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে, তাকে সায়েবের ঘরে ঢুকে সেলাম দিতে হয়।
সায়েব তখন ষাঁড়ের মতো ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করেন। জিজ্ঞাসা করেন, রাম সিং, মাই ডার্লিং রাম সিং, হাওয়া কী রকম?
কোমর থেকে ঝোলা ঝাড়নে হাতটা মুছতে মুছতে হেড বারম্যান বলে, হুজুর, বার আজ বোঝাই। দুটো ডাশুল হেগ, তিনটে হোয়াইট হর্স এর মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেক খদ্দের এসেছে-রেসের দিন। রাম সিং এবার নিবেদন করে, আরও খদ্দের আসছে। বার-এ তখন তার উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজনীয়।
ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করে সায়েব বলেন, ওই সব ছারপোকাগুলোকে নরকে যেতে দাও। তুমি এখানে আমার সঙ্গে গল্প করো।
রাম সিং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মথুরা সিং-এর মুখের দিকে তাকায়। মথুরা সিং মুখে কিছু বলে না, মনে মনে খুশি হয়। থাকো এখন দাঁড়িয়ে। রোজই তো মাতালদের চুষে অনেক রোজগার করছ, আজ না-হয় একটু কমই কামালে। অন্য লোকগুলো একটু চান্স পাক।
নেশার ঘোরে সায়েব এবার গান ধরেন। সায়েব বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন, অন্নপূর্ণা আজ ভিখারিনি হয়েছেন। শাজাহান হোটেলের সর্বেসর্বার রসনা নিজের সেলারে তৃপ্ত হয়নি; তাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার এক কুৎসিত বস্তিতে দেশি মদ টেনে এসেছেন। মুখের দুর্গন্ধে, বিলিতি মদে অভ্যস্ত রাম সিং-এর বমি ঠেলে আসছে। কিন্তু তবুও নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
সায়েবের এখনও মন ভরেনি। তাই গান ধরলেন। এ-গান অনেকদিনের পুরনো; কলকাতার প্রাচীন বিষাক্ত রক্তের সঙ্গে হাস্যরসিক ডেভি কারসনের এই গান মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। শাজাহান হোটেলের বার-এ এই গান অনেক মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেছে। মদন দত্ত লেন, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন অনেক বিদেশি কণ্ঠ উনিশ শতাব্দীর মধ্যরাত্রে এই গান গেয়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানিয়েছে, বেয়ারাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে
জলদি যাও, হাই খিদমতগার, ব্রান্ডি শরাব, বেলাটী পানি লে আও।
মার্কোপোলোর মত্ত দেহে আজ অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া বাধাবন্ধহীন কলকাতার সেই উচ্ছুঙ্খল আত্মা যেন ভর করেছে। সায়েব সুর করে গাইতে লাগলেন–
To Wilsons or Spences Hall
On Holiday stay;
With freedom call for the mutton chops
And billiards play all day;
The servant catches from after the hukum Jaldi Jao
Hi Kairmatgar, brandy slurab Bilati pani lao.
সায়েবের তৃষ্ণা এখনও মেটেনি। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন—লে আও..লে আও..হুইস্কি শরাব, ব্লাতি পানি লে আও।
তারপর মদে চুর হয়ে যাবেন মার্কোপোলো সায়েব। গেঞ্জি আর অন্তর্বাস পরা ওই বিশাল উন্মত্ত দেহটা দুজন চাকরের পক্ষে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সায়েব গেলাস ভাঙবেন, শূন্য মদের বোতল মেঝেতে ছুড়ে ফেলবেন। রাম সিংকে বুকে জড়িয়ে ধরে নাচবেন, আর গাইবেন। তারপর হঠাৎ যেন তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে। ডার্লিং, মাই সুইট ডার্লিং, বলে রাম সিংকে চুম্বন করতে গিয়ে চমকে উঠবেন।