লিজা কিন্তু তোমাকে খুব স্নেহ করে। তোমার প্রশংসা করলে।
এই অকারণ ভালোবাসায় আমার জীবন-মরুভূমি বার বার শ্যামল সবুজ হয়ে উঠেছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। বললাম, তিনি আমার বহু উপকার করেছেন।
মার্কো বললেন, লিজাকে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। পায়ের একটা এক্স-রে ছবিও তোলালাম। ডাক্তার বলেছেন সেরে যাবে। লিজা তোমাকে খবরটা দিতে বলেছে। আগামী কাল বিকেলে ওকে আবার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ জিমিকেও ছুটি দিয়েছি। ব্যাংকোয়েট হ-এর টি তুমি আর স্যাটা ম্যানেজ করতে পারবে না?
বললাম, আপনি লিজাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। বেচারা যা কষ্ট পায় দেখলে আমার চোখ দিয়ে জল আসে। আমরা টি পার্টি ম্যানেজ করে দেব।
মার্কো ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু তার মন ছাতাওয়ালা গলির সেই অন্ধকার বাড়িতে পড়ে রয়েছে। বললেন, কতদিন পরে লিজাকে দেখছি। ওর দেহ ভেঙে পড়েছে, কিন্তু ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছ? ও-দুটো আজও হিরের মতো জ্বলে।
সাংস্কৃতিক সমিতির চা-পান সভা আমরা দুজনেই ম্যানেজ করছি। দলে দলে সম্মানিত অতিথিরা এবং উৎসাহী সভা-সভ্যরা আসছেন। আজ সমিতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। তাদের স্থায়ী উৎসাহদাত্রী মিসেস পাকড়াশীকে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এই সভায় সহযোগিতা করছেন কলকাতার আরও কুড়িটি প্রতিষ্ঠান—যাঁদের লক্ষ্য শিশুমঙ্গল, নারী জাতির উন্নতি, সামাজিক বৈষম্য দূর ইত্যাদি।
সভা আরম্ভের এক মিনিট আগে মাননীয় সভাপতির সঙ্গে শ্রীমতী পাকড়াশী সাদা ব্লাউজ এবং লালপেড়ে একটা সাদা খদ্দরের শাড়ি পরে ব্যাংকোয়েট হল্-এ হাজির হলেন। মিসেস পাকড়াশীর চোখে আজ কালো চশমা নেই; দৃষ্টিতে সেই সর্পিণীর ভয়াবহতাও নেই।
টেবিলে টেবিলে চা পরিবেশিত হচ্ছে। কেক, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি প্রচুর পরিমাণে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। সভাপতি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ কলকাতা, তথা বাংলাদেশ, তথা ভারতের পরম গর্বের দিন।নারীজাতিকে যে সম্মান এবং উন্নতির সুযোগ আমরা স্বাধীন ভারতবর্ষে দিয়েছি, তা ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সহজলভ্য নয়। পৃথিবীর মধ্যে আর কোনো নারী ইতিপূর্বে মিসেস পাকড়াশীর মতো আন্তর্জাতিক নৈতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনের; সভানেত্রী পদে নির্বাচিত হননি। ভারতের নারী জাতির সনাতন আদর্শ মিসেস পাকড়াশীর মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে। ধনীর গৃহবধু হয়েও, তিনি প্রায় যোগিনী সাজেই সাধারণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন কলকাতার নোংরাতম বস্তিতে পর্যন্ত তাঁকে হাসিমুখে যখন কাজ করতে দেখি তখন আমাদের ভগিনী নিবেদিতার কথা মনে পড়ে যায়। তবুও সেই বিদেশিনী মহিলার সংসার ছিল না। আর এই সাধ্বী মহিলা স্বামী এবং জাতি কারও প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেননি।
আরও অনেক বক্তৃতা হল। বোসদা কানে কানে বললেন, শুনে যাও!
মিসেস পাকড়াশী ঘোমটা সামান্য টেনে দিয়ে বললেন, আর পাঁচজনের মতো আমি সামান্য একজন গৃহবধূ। সেইটাই আমার একমাত্র পরিচয়। স্বামী পুত্রের সেবা করে যতটুকু সময় পাই, সারা দেশে আমার যে মা, ভাই, বোন ছড়িয়ে আছেন তাদের কথা ভাববার চেষ্টা করি। যে সম্মান বিদেশ থেকে আমাকে দেওয়া হয়েছে, তা আসলে আপনাদেরই সম্মান। আমি নিমিত্ত মাত্র। সম্মেলনের পরেই আমার চলে আসবার কথা। নিজের ঘরসংসার, স্বামী পুত্র ছেড়ে গৃহস্থ ঘরের বধু কদিনই বা বাইরে থাকতে পারি বলুন? কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ দুর্গতির কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম—কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন দেশে নারীত্বের প্রতি কীভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে তা জেনে আসব।
সভায় এবার প্রচণ্ড হাততালি পড়ল। মিসেস পাকড়াশী এবার বললেন, পরিশেযে, ভারতের চিরন্তন নারীত্বের প্রতি দেশের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা যেন কখনই না ভুলি স্বামীরাই আমাদের সব।লতারও প্রাণ আছে, গাছেরও প্রাণ আছে—কেউ ছোট নয়। তবু লতা গাছকে জড়িয়ে বড় হতে ভালোবাসে। আমরা সেভাবে স্বামীকে জড়িয়েই বড় হব।
সভা থেকে বেরোবার আগে বোসদার সঙ্গে মিসেস পাকড়াশীর চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। যেন না দেখার ভান করে তিনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
ওঁদের বিদায় করে দিয়ে, ব্যাংকোয়েট হ-এ ফিরে এসে বোসদা বললেন, ওঁদের খবর শুনলে তো? এবার আমার খবর শোনো। এক নম্বর সুইটের সেই বিদেশি ছোকরাটির কথা মনে আছে তো? সেও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। একই প্লেনে সেও প্যারিসে যাচ্ছে! পুওর মিস্টার পাকড়াশী!
১৭. যেদিন প্রভাতে পরম বিস্ময়ে
যেদিন প্রভাতে পরম বিস্ময়ে শাজাহান হোটেলে পদার্পণ করেছিলাম, সেদিন থেকেই ঘড়ির কাঁটা দ্রুত পদক্ষেপে রাত্রের সন্ধানে ছুটতে আরম্ভ করেছে। এবার যেন সত্যিই বেলাশেষের সুর বেজে উঠবে। ক্লান্ত অপরাহু আমারই অজ্ঞাতে কখন দীর্ঘ-বিষণ্ণ ছায়া বিস্তার করেছে। দিগন্তের রঙে শাজাহানের আকাশ যেন রঙিন হয়ে উঠেছে।
এতদিন শাজাহান আমাকে কেবল মানুষ চেনবার দুর্লভ সুযোগই দেয়নি; আত্মীয় আবিষ্কারের অপার আনন্দও দিয়েছে। অপরিচিত এই পৃথিবীতে তাই কোনোদিন নিঃসঙ্গ বোধ করিনি। কিন্তু অশুভ চিন্তাগুলো এবার আমার বিনা অনুমতিতেই মনের মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে। আলোকোজ্জ্বল সভাগৃহে এবার একে একে নিভিছে দেউটি। শাজাহানের ঘাটে আমরা সবাই বেলাশেষের শেষ-খেলার প্রতীক্ষা করছি।