আমার পক্ষে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। বেদনাহত, যন্ত্রণাকাতর, জীবনানন্দে বঞ্চিত সঙ্গীতের পাশ্চাত্য ঋষিরা যেন দ্বারে দ্বারে অপমানিত হয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে এবার আমার পর্ণকুটীরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মন্ত্রমুগ্ধ সুজাতা মিত্র ও বোসদা পাথরের মতো বসে রইলেন। আমি চললাম গোমেজের ঘরের দিকে।
বিজলীবাতির স্তিমিত আলোকে প্রভাতচন্দ্ৰ আপন মনে ভায়োলিন বাজিয়ে চলেছেন। কে তুমি? বাণীর বরপুত্র, কার শাপে স্বর্গলোক থেকে ভ্রষ্ট হয়ে শাজাহানের নির্বাসনে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করছ? এই মুহূর্তে যে বিদেহী আত্মা তোমার অভিশপ্ত দেহের উপর ভর করে সঙ্গীতের মূৰ্ছনা তুলছেন তিনি কি ধনীপুত্র মেন্ডেলসন? না, দারিদ্র-লাঞ্ছিত শিশুপ্রতিভা মোসার্ট? তিনি কি দৃষ্টিহীন মৃত্যুপথযাত্রী জন সিবাস্টিয়ান বাক্? না, ভাগ্যহত বধির বীঠোফেন? অথবা ক্ষয়রোগগ্রস্ত মুমুর্ষ শোপা? আমি যে কিছুই জানি না। জানলে হয়তো তোমার যোগ্য সমাদর করতে পারতাম। মূক বধিরের সভায় তুমি যে সংগীত পরিবেশন করছ। দৃষ্টিহীনের দেশে তুমি যে দীপাবলীর আয়োজন করেছ।
শাজাহানের সামান্য সঙ্গীতজ্ঞ যেন এই মাটির পৃথিবীতে নেই। আঘাত, অপমান, অবজ্ঞা, দুঃখ, যন্ত্রণা, সব বিস্মৃত হয়ে তিনি পঞ্চেন্দ্রিয়ের দেহদীপধারে সুরধুনীর আরতি করছেন। আমি দেখলাম তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কে? প্রভাতচন্দ্র আমার ছায়া দেখে চমকে উঠলেন। সঙ্গীতের সারস্বত কুঞ্জে মূর্তিমান ব্যাধের সুরের বিহঙ্গরা মুহূর্তে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রভাতচন্দ্র আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন–No more noisy, loud word from me-such is my masters will. Henceforth I dead in whispers. The speech in my hart will be carried on in murmurings of a song.
কাব্যের দেবতা আজ যেন ক্ষমাসুন্দর চক্ষে শাজাহানের সামান্য কর্মচারীর উপর দৃষ্টিপাত করলেন। আমি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম :
কোলাহল তো বারণ হল
এবার কথা কানে কানে
এখন হবে প্রাণের আলাপ
কেবল মাত্র গানে গানে।
প্রভাতচন্দ্র আবার ভায়োলিন তুলে নিলেন। সেখানে যে সুর বেজে উঠল তা সৌভাগ্যক্রমে আমার পরিচিত :
শুধু তোমার বাণী নয় গো,
হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো।
প্রভাতচন্দ্র এবার চমকে উঠলেন। ডিনারের আর দেরি নেই। ভায়োলিনটা বিছানার উপর ফেলে রেখে, কোটটা হাতে নিয়ে, দরজাটা কোনোরকমে বন্ধ করে, দ্রুতবেগে তিনি নিচেয় নেমে গেলেন। ডিনারের আগে তার খেয়ে নেবার নিয়ম। আজ যে তাকে অনাহারে থাকতে হবে তা বুঝলাম।
তারাদের সাক্ষী রেখে সত্যসুন্দরদা ও সুজাতা মিত্র তখনও মুখোমুখি বসে রয়েছেন। আমি বললাম, মিস মিত্র, এবার কদিন আছেন?
সুজাতা মিত্র বললেন, কদিন মানে? আজ রাত্রেই বিদায় হচ্ছি।
আবার কবে আসবেন?
প্রায়ই আসতে হবে আমাকে। কদিন ছাড়াই আপনাদের জ্বালাতন করব।
বোসদা বললেন, আপনার জীবনের কথা ভাবলে হিংসে হয়।
হিংসেরই তো কথা! সুজাতা মিত্র উত্তর দিলেন। কেমন অদ্ভুত জীবন। হয় আকাশে, না হয় হোটেলে। রাতের অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, আমি তখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এরোড্রোম থেকে হোটেলের দিকে রওনা দিচ্ছি। ভোরবেলায় হোটেল ছেড়ে আবার এরোড্রোম। আজ এ-হোটেল, কাল আর-এক হোটেল, পরশুদিন আর-এক হোটেল।
বোসদা উত্তর দিলেন, সেই জন্যেই তো আরবদেশে বলে–Mortal, if thou wouldst be happy, change thy home often; for the sweetness of life is variety, and the morrow is not nine or thine.
সুজাতা মিত্র বললেন, আপনার সঙ্গে পড়াশোনা বা কোটেশনে পেরে ওঠা আমার কাজ নয়। আমি সামান্য এয়ারহোস্টেসঅ্যামপেনে ব্যাগেজ, টি, কফি, চকোলেট, আলকহলিক ড্রিংকস, ফ্লাইট এই সব বুঝি। হোটেলে কাজ করতে করতে এত পড়বার সুযোগ কেমন করে পান?
বোসদা হেসে বললেন, হোটেল তত পড়বারই জায়গা; কত উঠতি লোককে এখানে পড়তে দেখলাম! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন, আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিয়েছি। ডিনার শেষ করে একটু গড়িয়ে নিন। মধ্যরাতে আবার তো রওনা দিতে হবে।
শাড়ির আঁচলটা ঝাড়তে ঝাড়তে সুজাতা মিত্র উঠে পড়লেন। বোসদা বললেন, শুভ রাত্রি।
রাগ করে সুজাতা মিত্র বললেন, অত ইংরিজি কায়দা আমার ভালো লাগে।
বোসদা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন, বাংলা কায়দা অনুসরণ করলে বলতে হয় এসো। সেটা কি আপনি বরদাস্ত করবেন?
কপট ক্রোধে বোসদার দিকে তাকিয়ে, সুজাতা মিত্র এবার আমার সঙ্গে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। লিফটের সুজাতা প্রশ্ন করলেন, এখানে কতদিন আছেন?
বললাম, তেমন কিছু বেশিদিন নয়।
আর মিস্টার বোস?
উনি অনেকদিন। ওঁকে বাদ দিয়ে এই হোটেলের কথা ভাবা যায় না।
এমন মানুষ কেন যে হোটেলের চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে নিজেকে খরচ করে ফেলছেন, সুজাতা মিত্র আপন মনেই বললেন।
লিফ্ট থেকে নামবার আগে সুজাতা মিত্র হেসে বললেন, আসি ভাই। আবার দেখা হবে।
নিজের ঘরে মার্কোপোলো বুঁদ হয়ে বসেছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে মুখ তুললেন। বিছানায় বসিয়ে আমার পিঠে হাত রেখে এমনভাবে অভ্যর্থনা করলেন যে, কে বলবে তিনি ম্যানেজার এবং আমি সামান্য একজন রিসেপশনিস্ট? বললেন, লিজাকে তুমি কতদিন জানো?
বেশিদিন নয়। এই হোটেলে আসবার আগে কিছুদিন ওঁদের বাড়িতে রোজ ঝুড়ি কিনতে যেতে হত।